ঘরের দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অহরহ দেখা যায়। পশ্চিমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র আর পুঁজিবাদের সাথে বোনাস হিসেবে এখন এই দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধারের কালচারাল উপহারগুলো ইতোমধ্যে আমরাও পেতে শুরু করেছি। লোন মাদার, সিঙ্গল প্যারেন্ট—সে তো আরো আগেই পেয়েছি।
পাশ্চাত্যে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বহু আগেই। মৃত্যুর সময় তাই স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, অন্যান্য আত্মীয় পরিজন—কাউকেই খুব একটা কাছে পাওয়া যায় না। পশ্চিমা রক্ষণশীল ক্যাথলিক পরিবারগুলো এখনো নিজেদের পরিবার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে—চিত্রটা ততই যেন খারাপ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পশ্চিমা বস্তুবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে উন্নতি আর প্রগতির অন্যতম উপায় মনে করে অন্ধ অনুকরণের ফলে আমরা হারাতে বসেছি নিজস্ব জীবনবোধ। সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট—পরিবারগুলোতে আজ ভাঙনের সূর। সাথে আছে ছোট পরিবার ফেনোমেনা। ছোট পরিবারকে সুখি পরিবার হিসেবে জ্ঞান করার প্রবণতা অনেক আগেই ঢুকেছে আমাদের ভেতরে। কিন্তু সেই ছোট যে ছোট হতে হতে মৃত্যুর সময় একেবারে একক সংসারে পরিণত হবে তা হয়ত আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। নিজের সবচেয়ে আপন মানুষগুলোকে অসুস্থতা আর মৃত্যুর সময় কাছে না পাওয়া যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার—তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। তাই তারেক শামসুর রহমানের মতো বরেণ্য একাডেমিক স্কলারের, কিংবা অর্থমন্ত্রীর জামাতা কাসফির মরদেহ যখন ঘরের দরজা ভেঙে উদ্ধার করতে হয়, তা আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত বয়ে আনে।
ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো মুখরোচক স্পাইসি ধারণাগুলো কি আমাদের সত্যিই স্বাধীন করেছে? নাকি করেছে চরম স্বার্থপর আর ভোগবাদী? অবিরাম ক্যারিয়ারের পেছনে দুর্নিবার ছুটতে গিয়ে আমরা হয়ে পড়ছি একা, ভুগছি বিষণ্নতায়, হারাতে বসেছি জীবনের প্রকৃত অর্থ। পরিবারের সাথে কিংবা বন্ধুদের সাথে আমাদের আগের মতো সত্যিকারের আন্তরিক যোগাযোগ আর হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ভার্চ্যুয়াল জামানায় আমরা যেখানে আত্মপ্রচারে নিমগ্ন, সেখানে দু-একটা কমেন্ট আর ম্যাসেঞ্জারের আলাপ থেকে ভাবি—যথার্থ সামাজিক যোগাযোগ তো রক্ষা করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো—বর্তমান দুনিয়ায় প্রতি তিনজনে একজন একাকিত্বজনিত সিজোফ্রেনিয়া বা বিষণ্নতায় আক্রান্ত।
তারেক শামসুর রহমানকে ওনার একছাত্র একদিন বললেন, স্যার আপনি হলেন এ দেশের সবচেয়ে ধনী একাডেমিক বুদ্ধিজীবি। তখন তারেক শামসুর রহমান হেসে বলেছিলেন—Money can’t buy happiness. আসলেই তো, শান্তি কীসে পাওয়া যায়? শান্তি পাওয়ার জন্য অগাধ ধনসম্পদ, বিত্ত বৈভবের প্রয়োজন নেই। টাকা দিয়ে হয়ত কিছু বস্তুগত সুখ কেনা যায়, কিন্তু মনের খোরাক শান্তি কেনা যায় না। মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কিছু টাকার প্রয়োজন আছে বটে; তবে সেটুকু অর্থ সমাজের একেবারে নিম্নবিত্তের হাতেও আজকাল থাকে। দু’বেলা পেটভরে দু-মুঠো খেতে পারাটা সুখি হবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারো কাছে হাত না পেতে একটা সম্মানজনক জীবন কাটাতে টাকা লাগে। কিন্তু মানুষ যখন তার প্রয়োজনকে ছাপিয়ে বিলাসিতায় মত্ত হয়, ভোগবাদিতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, সেটা কি তাকে সত্যিই শান্তি এনে দিতে পারে?
শান্তি পেতে কী লাগে? যার একটা ভালোবাসার চাদরে জড়ানো পরিবার আছে, সম্পর্কে আন্তরিকতা আছে, সন্তানের প্রতি মমতা আর পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা আছে, যার আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস আর দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার ক্ষমতা আছে, সে কি সবচেয়ে সুখি মানুষ নয়?
ছোটবেলায় হয়ত এক মুচির গল্প শুনেছেন, যে কাজ করত আর মনের সুখে গান গাইত, যে অল্পতেই খুশি ছিল। একদিন এক ধনী ব্যক্তি তাকে এক থলে সোনার মোহর দেয়, যে সোনার মোহর তার মনের শান্তি কেড়ে নেয়। সে সব সময় সোনার মোহর হারিয়ে যাওয়ার কিংবা চুরি হওয়ার ভয়ে থাকত। ফলে তার মন থেকে শান্তি হারিয়ে গেল, মুখ থেকে গান হারিয়ে গেল। পরে মুচি সে সোনার মোহর ফিরিয়ে দিয়ে মনের শান্তি ফিরিয়ে আনে।
আরেক অভিযাত্রীর গল্প বোধহয় শুনেছেন, যে গুপ্তধনের খোঁজে পরিবার ছেড়ে অভিযাত্রী হয়েছিল। সে তার নিঃসঙ্গ গোটা জীবন কাটিয়ে দিল গুপ্তধনের সন্ধানে, যেখান থেকে মিলবে রাশি রাশি সোনার মোহর। একদিন সে যখন সত্যিই গুপ্তধনের সন্ধান পেল, তখন সে শক্তিহীন থুড়থুড়ে বুড়ো। সেদিন রাশি রাশি সোনার মোহর হাতে নিয়ে সে আফসোস করে বলেছিল— হাতে পেলে মাটি হয়ে যায় সোনার মোহর।
সুখ মেলে আন্তরিক সম্পর্কে, ভালোবাসায়, অল্পে তুষ্ট থাকার মাঝে আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায়। এই যান্ত্রিক দুনিয়া আমাদের সম্পর্কের গভীরতা কেড়ে নিতে চায়, ভালোবাসাগুলো মুছে দিতে চায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আর ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে চলা আমাদের স্বার্থপর করে, সুখি করে না। আত্মপূজারী কখনো সুখি হয় না। আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান ও কৃতজ্ঞতাবোধ, পরিবারের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্পর্কের যত্ন, পরার্থপরতা, হালাল রিযিক আর অল্পে সন্তুষ্ট থাকা—ব্যাস, এক জীবনে সুখি হতে আর কী লাগে?
© জাহিদ হাসান
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান