মানুষের হৃদয়টা খোলা আকাশের মতো। তাতে যেমন ভোরের সূর্যরশ্মি উছলে পড়ে, তেমনিভাবে সেই আকাশ ছেয়ে যেতে পারে সন্ধ্যার গাঢ়, নিকষ কালো অন্ধকারে। সেই আকাশে খেলা করতে পারে মুক্ত গাঙচিল। আবার, তাতে নেমে আসতে পারে রাজ্যের স্থবিরতা। নীলে নীলে নীলাভ হয়ে যাওয়া আকাশ মুহূর্তেই হয়ে পড়তে পারে কৃষ্ণগহ্বরের মতো অন্ধকার।
আমাদের হৃদয় হলো আকাশের মতো। তাতে যখন বিশ্বাসের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়, তখন আমাদের হৃদয়ের আকাশে খেলা করে সকালের সোনা রোদ। যখন বিশ্বাসের সুরে আমরা আমাদের হৃদয় আকাশকে রাঙিয়ে নিই, তখন হৃদয়ের ক্যানভাস হয়ে ওঠে আলো ঝলমলে।
আবার, যখন আমাদের হৃদয়ের আকাশে ভর করে অবিশ্বাসের মেঘ, তখন হৃদয়জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। সেই বিষাক্ত অন্ধকার গ্রাস করে নেয় সবকিছুকে। গিলে খায় সব নীল, সব সুন্দর।
অবিশ্বাস আর সন্দেহের করাঘাতে পৃথিবী আজ জর্জরিত। প্রশ্ন আর সন্দেহের নামে বিশ্বাসী অন্তরগুলোতে অবিশ্বাসের বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দিতে একটা মহল সদা তৎপর। তারা প্রশ্ন আর মুক্তচিন্তার নামে সাজিয়ে রেখেছে অবিশ্বাসের পসরা। বিশ্বাসীদের ‘মুক্তচিন্তক’ আর মুক্তচিন্তার নামে পরিণত করতে চাইছে ‘অবিশ্বাসী’তে। ধর্মবিদ্বেষের বিষ অন্তরে ঢুকিয়ে দিয়ে ধর্মবাদীদের এরা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ধর্মবিদ্বেষীর কাতারে। তাদের অযাচিত মিথ্যাচার আর প্রোপাগান্ডার ফলে অনেক বিশ্বাসী তরুণ-তরুণী খেই হারিয়ে ফেলে। জড়িয়ে যায় একটা আত্মবিধ্বংসী কাজে। তলিয়ে যায় একরাশ অন্ধকারে। মিথ্যা মোহ আর অলীক মায়ার প্রেমে পড়ে এরা ছুটে চলে একটা মরীচিকার পেছনে…
সভ্যতার এই সংকট আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। পৃথিবীতে যুগে যুগে এরকম অনেক সংকট বিরুদ্ধবাদীরা তৈরি করেছে এবং করছে। তবে, বিশ্বাসী শিবিরও কখনো থেমে থাকেনি। যখনই বিশ্বাসের গায়ে আঘাত এসেছে, প্রতিঘাতে তার জবাবও দেওয়া হয়েছে সমানভাবে। যখনই বিশ্বাসকে চূর্ণ করতে চাওয়া হয়েছে, তখনই বিচূর্ণ হয়ে পড়েছে অবিশ্বাসের দেওয়াল। বিশ্বাসের স্রোতধারাকে থামিয়ে দিতে এসে স্তব্ধ হয়ে গেছে কত অবিশ্বাসের জোয়ার!
এক প্রচ্ছন্ন বিকেলে, মুন্তাদা-আত তাওহিদ নামক একটি অনলাইন ফোরামে ‘আবুল হাকাম’ নামের একজন অবিশ্বাসী একটি মন্তব্য করে। তার মন্তব্যের প্রতিউত্তর নিয়ে আসে একজন বিশ্বাসী। এরপর? এরপর শুরু হয় তাদের মধ্যে বাদানুবাদ, তর্কাতর্কি। অবিশ্বাসীর যত প্রশ্ন, যত জিজ্ঞাসা, যত কৌশল, সব প্রকাশ করে সে পরাজিত করতে চায় বিশ্বাসী প্রাণের ওই মানুষটিকে। কিন্তু পরম প্রজ্ঞা আর ধৈর্যের সাথে বিশ্বাসী প্রাণের মানুষটি একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। ভেঙে দেয় অবিশ্বাসের দেয়াল। সেই বিশ্বাসী প্রাণের নাম ড. হুসামুদ্দীন হামিদ। উক্ত ফোরামে তার এবং আবুল হাকামের মধ্যকার উত্তর-প্রতিউত্তরের সংকলনের নামই হলো মেঘ কেটে যায়।
বইটিতে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের জবাব-ই দেওয়া হয়নি, সাথে সাথে তুলে ধরা হয়েছে ইসলামের সুমহান আদর্শ, মাহাত্ম্য এবং সর্বোপরি জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের কার্যকারিতা। ইসলাম যে সর্বাকালে, সর্বযুগে এবং সর্বাবস্থায় একটি যুগোপযোগী জীবন বিধান, বইটির পরতে পরতে লেখক সেটা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এমন না যে এই বইটি অথবা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেবল একজন অবিশ্বাসীর জানা দরকার। এই জবাবগুলো সমানভাবে একজন বিশ্বাসী মানুষেরও জানা থাকা উচিত। ইসলাম কেন এবং কীভাবে সত্যধর্ম হবার দাবি রাখে, এই সত্য সকল মুসলিমের জানা থাকা অত্যাবশ্যক।
মুহাম্মদ রুবেল মিয়া –
নাম : মেঘ কেটে যায়
লেখক : ড. হুসামুদ্দীন হামিদ
অনুবাদক : আব্দুল্লাহ মজুমদার
সম্পাদক : ডা. শামসুল আরেফিন শক্তি
প্রকাশনায় : সমকালীন প্রকাশন
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৫৬
মুদ্রিত মূল্য : ২৬৮
যখন অবিশ্বাসের কালো মেঘ একজন মানুষের হৃদয় আকাশকে দখল করে নেয়, তখন সত্যের স্নিগ্ধ, মনোরম, চোখজুড়ানো আলো তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। কারণ অবিশ্বাসের কালো মেঘ এতোটাই ঘন ও জঘন্য যে, তা আলো প্রবেশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হিদায়াতের কথা বলা যায় না। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকেই হিদায়াত দিতে পারেন। একমাত্র তিনিই পারেন একজন অবিশ্বাসীর হৃদয়ের কালোমেঘ হটিয়ে সেখানে সত্যের আলো প্রবেশ করাতে, যা তাঁর হৃদয়কে আলোকিত করবে, মনকে শান্ত ও পরিতৃপ্ত করবে, জান্নাতের বাগানে তাঁর স্বপ্নগুলোকে অবগাহন করাবে।
হিদায়াত আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে দিতে পারেন। বান্দার অনিচ্ছায় হোক আর বান্দার হৃদয়ের আকুতিতেই হোক। আল্লাহর সৃষ্টি অনুধাবন করার মাধ্যমেই হোক বা কোনো দায়ীর হৃদয়স্পর্শী কথামালার দ্বারাই হোক। “মেঘ কেটে যায়” বইয়ে এমন একজন ব্যক্তির ইসলামে ফিরে আসার বাস্তব চিত্র দেখানো হয়েছে, যিনি একসময় অবিশ্বাসের কালো অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই অন্ধকার তাঁর মনকে অনিয়ন্ত্রিত করে তুলেছিলো। ফলে সে চাচ্ছিলো এই অন্ধকারকে ঝেড়ে ফেলে বাস্তবতায় ফিরে আসতে। কিন্তু তাঁর মনে ছিলো কিছু প্রশ্ন, যা তাঁকে অবিশ্বাসের পথে নিয়ে যায়। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পাওয়ায় সে হিদায়াতের পথে আসতে পারছিলো না। তাই সে উত্তর খোঁজার জন্য স্মরণাপন্ন হয় বিখ্যাত দায়ী ড. হুসামুদ্দীন হামিদের কাছে। ড. হুসামুদ্দীন হামিদের ভালোই জানা ছিলো কোন ধরনের ব্যক্তিকে কিভাবে সত্যের পথে আনা যায়, আলোর পথ দেখানো যায়। তিনি সে অনুযায়ী আবুল হিশামের (ওই অবিশ্বাসী) উপরও দাওয়াহর কাজ চালাতে থাকেন। যুক্তি, প্রমান আর হৃদয়স্পর্শী কথামালার মাধ্যমে তিনি মুহূর্মুহু আবুল হিশামের মনে আঘাত করতে থাকেন, ফলে তাঁর মন একসময় সত্যের আলোকচ্ছটা পেতে সামর্থ্যবান হয়, এবং আবুল হিশাম অন্ধকার জগতকে ত্যাগ করে আলোকময় জগতে ফিরে আসে।
ভালো লাগা :
আমি আমার জীবনে যতগুলো বই পড়েছি, “মেঘ কেটে যায়” বইটিকে এর মধ্যে অনন্য পেয়েছি। বইটি বারবার আমাকে ভাবিয়েছে, আমার অশ্রু বিগলিত করিয়েছে, আমার হৃদ মাঝারে মুহূর্মুহু আঘাত করেছে। আমাকে আমার রবের কুদরাত চিনিয়েছে, আমার রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ত্যাগ, তিতিক্ষা আমার চোখের সামনে তুলে ধরেছে, আমার রাসুলের ভালোবাসা আমার অন্তরে জাগ্রত করেছে। এতো সুন্দর কোনো বইও হতে পারে! আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম, বইয়ের প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমার ইমানকে শানিত করছে। এজন্যই বোধহয় ডা. শামসুল আরেফিন শক্তি ভাই বইটিকে সপ্তাহে অন্তত একবার করে পড়ার কথা বলেছেন।
বইটি পড়ার প্রয়োজনীয়তা :
বইয়ের প্রতিটি কথা একজন মানুষের হিদায়াত লাভের জন্য যথেষ্ট। আবুল হিশামের প্রশ্নগুলোকে মনে হবে আপনারই প্রশ্ন আর ড. হুসামুদ্দীন হামিদের উত্তরগুলোকে মনে হবে এটাইতো আমার জানার ছিলো। পাঠক ড. হুসামুদ্দীন হামিদের ভাষায় যখন আমাদের রবের কুদরাতের আলোচনা শুনবেন তখন মনে হবে এতো বড়ো আমার রব! এতো সূক্ষ্ম তাঁর সৃষ্টি! এতো বিশাল তাঁর সৃষ্টিজগত!
যখন আমাদের রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসলাম প্রচারের কারণ, ধরন আর ত্যাগ -তিতিক্ষা সম্পর্কে জানবেন, যখন সাহাবায়ে কেরামের রাসুলুল্লাহের প্রতি ভালোবাসার আলোচনা শুনবেন তখন আপনার মনেও জাগ্রত হবে নবিপ্রেম। বুঝতে পারবেন আমাদের রাসুলের ইসলাম প্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং আমাদের প্রতি আমাদের রাসুলের প্রেম ও মোহাব্বাত।
বইটি পাঠ করলে আমাদের ইমান বৃদ্ধি পাবে। এজন্যই বাংলাদেশের প্রখ্যাত দায়ী ডা. শামসুল হকের শক্তি ভাই বলেছেন প্রতি সপ্তাহে বইটি অন্তত একবার পাঠ করার জন্য। এ থেকেই বুঝা যায় বইটি পাঠ করা আমাদের জন্য কতোটা প্রয়োজনীয়।
শেষ মন্তব্য :
আমাকে যদি বলেন বইটিকে রেটিং দেওয়ার জন্য, তবে আমি অবশ্যয় ১০ এ ১০ দিব। পারলে আরো বেশি দিব। আব্দুল্লাহ মজুমদার ভাইয়ের বই বাছাই আর অনুবাদ আমার এতোটাই পছন্দ যে উনার বাছাই করা আর অনুবাদ করা বই জানতে পারলেই পড়তে মনে চায়। এর অন্যতম কারণ, এই “মেঘ কেটে যায়” আর “তিনিই আমাকে রব” বইদুটি।
সবাইকে বইটি পড়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেষ করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমল করার তওফিক দিন। আমিন।