মুসলিম পরিবারের এক লোক। বিয়ে করবেন এক খ্রিস্টান মহিলাকে। শর্ত কী? শর্ত হচ্ছে লোকটাকেও খ্রিস্টান হয়ে যেতে হবে। লোকটা শর্ত মেনে নিল। নিজের ধর্ম ইসলাম ত্যাগ করে বরণ করে নিল খ্রিস্টধর্ম।
তাদের দুই মেয়ে। ইসলাম ছেড়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়া বাবা এবং খ্রিস্টান মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া দুই বোনও বেড়ে উঠতে লাগলো খ্রিস্টান ধর্মের পরিবেশে। আস্তে আস্তে তারা যীশু খ্রিস্টকে তাদের প্রভু এবং মাদার মেরীকে ঈশ্বরের স্ত্রী বলে বিশ্বাস করা শুরু করল (নাউজুবিল্লাহ)। এভাবেই বেড়ে ওঠে তারা।
কিন্তু এরপর? একটি দমকা হাওয়া। এক হাওয়াতেই সবকিছু কেমন যেন ওলোট-পালট হয়ে গেল। বড় মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ শুরু করল। তার দাবি, সে এক মহাসত্যের সন্ধান পেয়েছে। এই সত্য যীশুকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র বলে না। মাদার মেরীকে ঈশ্বরের স্ত্রী বলে স্বীকার করে না। এই সত্য বলে- যীশু কেবল একজন মানুষ। একজন নবী। একজন বার্তাবাহক। এই সত্য বলে- মাদার মেরী কেবল একজন বিদূষী, পবিত্র নারী। একজন পবিত্র মা। এই সত্যে ত্রিত্ববাদের (Trinity) কোনো স্থান নেই। এই সত্য একত্ববাদে বিশ্বাসী। এই সত্য একত্ববাদের কথা বলে। মেয়েটা এই সত্যের পেছন পেছন ছুটতে থাকে। এই সত্য তাকে রাস্তা বাতলে দেয়। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে।
ছোটরা অনুকরণপ্রিয়। মেয়েটার ছোটবোনও তার বড় বোনকে অনুকরণ, অনুসরণ শুরু করে। যে ধ্রুব সত্যের পেছনে বড় বোন ছুটছে, সেটা দাগ কেটে বসে ছোটবোনের মনেও। সেও সেই মহাসত্যকে অনুধাবন করতে পারে। তারা দুজন মিলে পাড়ি জমায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে। এই জগতে তাদের শত্রু হয়ে ওঠে তাদেরই একসময়কার চিরচেনা সমাজ, পবিবেশ, পরিবার… কেমন করে তারা টিকে থাকে? কী তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সেই মহাসত্যকে আপন করে নিতে? ফেরা বইটা এই গল্প নিয়েই…
ফেরা বইটি থেকে পাঠকরা দুজন সত্য অনুসন্ধিৎসু বোনের আকুতি বুঝতে পারবেন। সত্যকে মেনে নেওয়ার, গ্রহণ করার জন্য তাদের চেষ্টা, তাদের ত্যাগকে বুঝতে পারবেন। যে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তারা সত্যের কাছাকাছি এসেছিল, সেটাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে পাঠকের সামনে, ইনশাআল্লাহ।
সত্যকে খুঁজে পাবার সেই সত্য গল্পটি আমাদের কাছে তুলে ধরার জন্য লেখিকা সিহিন্থা শরীফা এবং নাইলা আমাতুল্লাহ আপুকে আল্লাহ উত্তম জাযা দান করুন, আমিন।
সিরাজাম বিনতে কামাল –
বইয়ের নাম: ফেরা
রচনা: সিহিন্তা শরীফা
নাইলাহ আমাতুল্লাহ
সম্পাদনা: শরীফ আবু হায়াত আপু
প্রকাশনী : সমকালীন
মূল্য: ১৭২/-
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২০
🔸রিভিউ কথন:
_______________
অন্য ধর্ম থেকে মুসলিম হওয়ার গল্প আমি আগেও পড়েছি কিন্তু এই বইয়ের গল্পটা ইউনিক।
.
কুরআনের আয়াতের অর্থ পড়লে অনেক জায়গাতেই দেখা যায়,আল্লাহ এইরকম বলেছেন,”এ’সব কিছুই চিন্তাশীলদের জন্য নির্দশন, যদি তারা চিন্তা করে।”
আমার কাছে গল্পের বড় বোন সিহিন্তা আপুকে সেই চিন্তাশীলদের একজন মনে হয়েছে।
কারণ অন্যান্য নওমুসলিমদের মত তিনি এমন ছিলেননা যে “ছোট থেকেই আমার ধর্ম আমার ভাল লাগত না অদ্ভুত লাগত বা আমার প্রতিবেশী/ফ্রেন্ড মুসলিম ছিল ওকে আমার খুব ভাল লাগত বা মুসলিমদের আজান শুনতে খুব ভাল লাগত বা কারো প্রেমে পড়ে তার মুসলিম হওয়া।”
সিহিন্তা আপু নিজের ধর্ম(খ্রিষ্টান) খুব ভালভাবে পালন করতেন। ছোট থেকেই খুবই ধার্মিক ছিলেন।পাশাপাশি মুসলমানদেরকে তিনি এক্টুও পছন্দ করতেননা।
কিন্তু কুরআনের আয়াতে তো বলা আছে,”আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন” হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়াও যে আল্লাহ্’রই বিশেষ অনুগ্রহ।
এজন্যই হয়তো আপুর নিজের ধর্ম নিয়েই নিজের মনে এত প্রশ্নের উদয় হওয়া, সেমিস্টার ড্রপ হওয়া। পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটার কারণে অবসর সময়টুকুতে সংগ্রহের সব বই পড়ে নিজেদের ই পবিত্র গ্রন্থ “বাইবেল” এ হাত দিয়ে বুঝতে পারা যে, যীশু নিজেই তো অন্য এক রবের প্রার্থনা করেন, অন্য এক প্রভুর ইবাদাত করেন তাহলে যীশু কিভাবে হল তাদের প্রভু। যীশুই বলে গিয়েছেন, তোমরাও সেই রবেরই ইবাদাত, প্রার্থনা করো।
বাইবেল পড়ার পর আপু হন্যে হয়ে সঠিক উত্তরগুলো খুঁজলেন। কোথাও উত্তর পেলেননা। ততদিনে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে “পীচ টিভি”র বিভিন্ন লেকচার শুনা শুরু করলেন, বিভিন্ন বই কালেক্ট করা শুরু করলেন, ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি শুরু করলেন।
আস্তে আস্তে প্রশ্নের উত্তর আর আত্মিক শান্তি দুটোই আপু পেলেন। সাথে ছোটবোন নাইলা আপুকেও এক্টু এক্টু বলতেন। সবকিছুর সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে গেলো তার চলাফেরা। বড় বড় জামা পড়া, বিউটিপার্লারে যাওয়া বাদ দেওয়া।
চুপিচুপি ওযু করা, ইশারায় নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত শুনা, সেহরি করে/ না করে রোজা রাখা, ছুটির দিনে তার মা বাসায় থাকত বলে রোজা রাখতে না পারার কারণে মনে মনে কষ্ট পাওয়া।
অতঃপর একদল দ্বীনিবোনদের সাহায্যে তাদের শাহাদাহ পড়া এবং সুন্দর স্বপ্নের মতই আল্লাহ্’র অশেষ অনুগ্রহে সহজ, সুন্দরভাবেই দু’বোনেরই বিয়ে সম্পন্ন হওয়া।(প্রথমে সিহিন্তা আপুর পরে নাইলা আপুর)
আপুর মা হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী বা তার ভালবাসা পূর্ণতা পেলো। তিনিই জিতেছেন।
কারণ তাকে বিয়ে করার জন্যই আপুদের বাবা নিজ ধর্ম (ইসলাম) ত্যাগ করেছেন।
কিন্তু বিজয় তো মহান রাব্বুল আলামীনের। একজন মায়ের ২টা মেয়েই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেছেন, যে ভয়টা পেতেন ভদ্রমহিলা সেই ভয়টাই ঠিক হল।
“তারা চক্রান্ত করেন আর আল্লাহ্ কৌশল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।” (সূরাহ আল-ইমরান,আয়াত:৫৪)
সুবহানআল্লাহ! কত সুন্দর কৌশলেই না এত খবরদারিতার পরেও এত ধার্মিক মেয়েটাও নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম শান্তির ধর্মে ফিরে এসেছেন। জয়ী হলেন মহান রাব্বুল আলামীন।
বইটা পড়ার সময় বার বার গা শিউরে ওঠছিল। মুগ্ধ হয়েছিলাম দ্বীনিবোনদের ওপর। অদেখা, অচেনা দ্বীনিবোনদের আবারো প্রবলভাবে ভালবাসতে শুরু করলাম। বিশ্বাস হল হ্যা, রক্তের বন্ধনের চেয়েও কালেমার বন্ধন অতীব শক্তিশালী, ভালবাসার।
আমি মনে করি, বইটা কোন অমুসলিম পড়লেও তার মনে ভাবনার সৃষ্টি হবে। আর আমরা মুসলিমদের জন্য বেস্ট রিমাইন্ডার। কারণ, আমরা জন্মসূত্রে মুসলিম। কতই না ভাগ্যবান! অথচ, শুধুমাত্র নিজের নফসকে খুশি করতে গিয়ে নাম লিখছি গাফেলদের দলে।
অমুসলিমরাও যদি রব্বকে আপন করে নিতে পারে, আমরা কেন নয়! কিসের জন্য এত কাছে রেখেও রব্বকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি আমরা নিজেরাই। আজই তওবা করা উচিত, ফিরে আসা উচিত রব্বের ছায়ায়।
Meher Afroz –
📘বুক রিভিউ📗
বইঃফেরা-১
লেখকঃসিহিন্তা শরীফা,নাইলাহ আয়াতুল্লাহ
প্রকাশনীঃসমকালীন প্রকাশন
সিহিন্তা শরীফ ও নাইলাহ আমাতুল্লাহ আপন বোন।তাদের বাবা ছিলেন একজন ‘মুসলিম’ এবং মা খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। একসময় তাদের বাবা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে।তাই স্বাভাবিকভাবেই খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠেন দুইবোন। একসময় ধার্মিক সিহিন্তা সত্যের সন্ধান পায়। জানতে শুরু করে প্রকৃত দ্বীন ইসলাম’ কে গভীরভাবে। অনুভব করে, ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম। তারা ব্যকুল হয়ে যায় সত্যকে গ্রহণ করার জন্য। আর তাই দ্বীনে ফেরার জন্য যা যা ত্যাগ করা দরকার তার সবই করেছিলেন এই দুইবোন। তাদের সেই সাহসী প্রত্যাবর্তনের গল্প নিয়েই রচিত হয়েছিল ‘ফেরা’ বইটি।
বইটি যাদের জন্যঃ—
⇨আমার আপনার মতো যারা মুসলাম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং এতো সুবিধা ভোগ করার পরও যথাযথভাবে দ্বীনের রজ্জুকে আকড়ে ধরছেন না।ফরজ/সুন্নাত ইবাদাত পালনে হেলাফেলা করছেন তাদের বইটা পড়া উচিৎ।
⇨যারা সত্য সন্ধানী অথচ সংসয় থাকার কারণে ইসলামকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করছে তাদের বইটা পড়া উচিৎ।
⇨ যারা গল্প-কথন পড়ে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করতে চান বইটি তাদের জন্যও।
পাঠ্যানুভূতিঃ—
বইটা পড়ে মনের ভেতর দুই রকম অনুভূতি খেলা করছিলো।প্রথমত, গর্ববোধ করছিলাম এটা ভেবে যে আমি মুসলিমাহ।দ্বিতীয়ত, সিহিন্থা/ নাইলাদের চেয়ে এতো এতো ফ্যাসিলিটি পেয়েও ইবাদাতের ক্ষেত্রে কত সময় অবহেলা করেছি আমি।ভাবলেই আফসোস করি।
সিহিন্তা প্রথম সালাত আদায় করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে।আবার প্রথম রোজা রেখে ইফতার করে কেঁদে উঠে। সিহিন্তার সাথে যেন কেঁদে উঠছিলাম আমিও।সে কেঁদেছিলো সত্যের সন্ধান পেয়ে আর। আমি কেঁদেছিলাম সত্যকে আমার হৃদয়ে তাঁর মতো করে আকঁড়ে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি বলে।
বইটার পরতে পরতে আমি প্রশান্তি খুঁজেছি। খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি আমার জীবনের ভুল-ত্রুটি। তাদের এতো ক্রাইসিস এর দিনগুলো পড়ে মনে হত, ইস! ঐরকম ক্রান্তিকালে আমি যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারতাম।
সত্যিই এক অসাধারণ বই এটা।নিজেকে অন্য ভাবে ভাবানোর মত বই।মনে প্রশান্তি অনুভব হয় যেমন বই পড়ে তেমন বই ‘ফেরা’। এভাবে ফিরে আসা হোক সবার জীবনে।এমন কি মুসলিমদের ও।ফিরে আসুক নিজের রবের কাছে। প্রচ্ছদ, বাইন্ডিং কোথাও কোনো খুঁত খুঁজে পাইনি।
Review Writer: Meher Afroz