চিন্তালাপ

প্যারাডক্সিকাল জাতীয়তাবাদ — আশিক আরমান নিলয়

১.

একটা মানুষের অনেকগুলো পরিচয় থাকে। পারিবারিক পরিচয়, লৈঙ্গিক পরিচয়, শিক্ষাগত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগত পরিচয়, পেশাগত ও কর্মস্থলগত পরিচয়, ধর্মীয় ও ধর্মীয় গ্রুপগত পরিচয়; সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, মহাদেশীয় পরিচয়। এই পরিচয়ের মাধ্যমে সে একই সাথে কারো সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় আর কারো থেকে আলাদা হয়। এমনকি শুধু মানুষ বা জীব হিসেবেও তার একটা পরিচয় আছে, যা দ্বারা সে পশুপাখি ও জড়বস্তু থেকে আলাদা। একদল মানুষ যখন একটা পরিচয়ের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন অবশ্যই তার অন্য পরিচয়গুলোকে suppress করা লাগে। একটা পরিচয়ের সাপেক্ষে অন্যগুলোকে নিতান্ত অগুরুত্বপূর্ণ বা একেবারেই অস্তিত্বহীন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে ওই একটা পরিচয়ই তার আদি ও অকৃত্রিম পরিচয়, বাকিগুলো মেকি আর ঠুনকো। এই ধারণাটা মাথায় ঢুকাতে তৈরি করা হয় কিছু ন্যারেটিভ।

বর্তমান বিশ্বে যে পরিচয়টাকে মানুষ অত্যন্ত পবিত্র বলে মানে, এর ভিত্তিতেই ঐক্যবদ্ধ ও পৃথক হয়, সেটি হলো জাতীয়তাবাদ। সীমানা ঘেরা একটি ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্গত সকল মানুষ একটি ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী। বাকিরা ‘others’. এই পরিচয়টিকে প্রাকৃতিক হিসেবে দেখানোর জন্য তৈরি করা ন্যারেটিভ হলো জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় ফল, ফুল, মাছ, পাখি, কবি ইত্যাদি—যাতে এই সিম্বলগুলোকে ধরে মানুষ এক হয়। উত্তরবঙ্গের মধ্যবয়স্ক মুসলমান পুরুষ আর পার্বত্য চট্টগ্রামের কিশোরী বৌদ্ধ যেন নিজেদের একই কম্যুনিটির লোক বলে ধরে নেয়।

মজার ব্যাপার হলো, এই ‘জাতীয়’ সিম্বলগুলো তৈরি করার সময় উত্তরবঙ্গের ওই পুরুষ বা পার্বত্য চট্টগ্রামের কিশোরীর মতামত চাওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষের আসনে থাকা একদল মানুষ এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে তারপর তাদের জানিয়েছে, “এই নাও, এই হলো তোমার পরিচয়।” কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকেই অনাদি, অকৃত্রিম ও প্রাকৃতিক ধরে নিয়ে তার ভিত্তিতে সেই পুরুষ ও কিশোরী নিজেদের চিন্তাধারা, আবেগ, অনুভূতিকে রি-চ্যানেল করে নিয়েছে। নিজেদের সন্তানদেরও তারা জন্মের পর থেকে এই ছাঁচেই গড়ে তুলবে। বইয়ে তাদেরকে পড়াবে “এটা তোমার জাতীয় ফল, স্বাদ ভালো লাগুক বা না লাগুক। এটা তোমার জাতীয় ফুল, জীবনে চোখে দেখো বা না-ই দেখো।” স্কুলে প্রতিদিন রুটিন করে গাওয়ানো হবে জাতীয় সঙ্গীত। প্রায় পুরো জীবনভর এই ড্রিলিং প্রসেসের মাধ্যমে তাকে বারবার জানানো হতে থাকবে যে, এটাই তোমার আসল পরিচয়।

জাতীয়তাবাদভিত্তিক পরিচয়টা আসলেই অনাদি, অকৃত্রিম না। একটা সময় মানবজাতি রাজনৈতিকভাবে সাম্রাজ্য আকারে বিভক্ত থাকত বটে। কিন্তু মানুষে-মানুষে ঐক্যের দর্শন হিসেবে কাজ করত ধর্মীয় বিশ্বাস। মধ্যযুগের খ্রিষ্টান-বিশ্ব নিজেদের ভেতর ‘ইংল্যান্ড’, ‘ফ্রান্স’ এরকম পরিচয়গুলোকে ভালো চোখে দেখত না। ইসলামি খিলাফাহর মতোই তাদের মাঝে Christendom এর ধারণাটা খুব সম্মানের জিনিস ছিল। খ্রিষ্টের রাজ্য! সমগ্র খ্রিষ্টান জাতি এক জাতি।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিক দিয়ে আলাদা আলাদা হলেও, ধর্মীয় দিক দিয়ে অখণ্ড এই খ্রিষ্টান-বিশ্বের মাঝে Nationalism ছিল নিন্দনীয় একটা ব্যাপার। আজকের যেসব জাতিরাষ্ট্র সেই অখণ্ড Christendom এর অংশ ছিল, তাদের সবার জাতীয় পতাকায় এখনো দেখবেন বিভিন্ন আকৃতিতে ক্রুশ আঁকা।

২.

‘জাত গেল জাত গেল’ বলে এ কী আজব কারখানা?


জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভের একটি মূল লক্ষ্যই থাকে ধর্মীয় ঐক্যের আবেগগুলোকে দমন করা। কাজী নজরুল ইসলামের যেসব কবিতা (বা গান) কানে আসামাত্রই বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ রক্তের ঢেউ টের পাওয়া যায়, তার একটা হলো ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’। ধর্মীয় পরিচয়কে suppress করে জাতীয় পরিচয়কে glorify করা কবিতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কয়েকটা চরণ এরকম-

“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার”


স্পষ্টতই এখানে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে মানবীয় পরিচয়কে। মজার ব্যাপার হলো, যেই ইংরেজদের শোষণের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করছে এই কবিতা, তারাও কিন্তু মানুষ ছাড়া কিছুই নয়। আর এখানে মানবজাতির সকল মানুষকে এক হতে বলা হচ্ছে না। শুধুমাত্র বাঙালিদের, বড়জোর সকল ভারতীয়দের ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

“কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,

বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।”

আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, যার নেতৃত্বে বাঙালিরা ক্লাইভের খঞ্জরের নিচে পড়েছে, সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না। আলিবর্দি খাঁ থেকে নানা-নাতি সূত্রে প্রাপ্ত রাজত্বের কারণে তিনি ছিলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব। ক্লাইভ যদি এখন বলে বসেন—সিরাজউদ্দৌলার অধীনে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকতে পারলে ব্রিটিশ শাসনকে পরাধীনতা কেন বলা হয়?

আমার কাছে অন্তত এর কোনো শক্ত জবাব নেই।


কাণ্ডারীতে ফিরে যাই। কবিতাটার সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ চরণটা আছে সর্বশেষ stanza-তে।

“আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?”

কবি আমাদের দুইটা অপশান দিয়ে অধিক যৌক্তিকটা বেছে নিতে বলছেন। যেকোনো একটার জন্য লড়াই করতে হবে—জাতি, অথবা জাত। জাতিকে বাঁচাতে হলে জাত বিসর্জন দিতে হবে, জাত রক্ষা করতে গেলে জাতি হারাতে হবে। পার্থক্যটা ধরতে পেরেছেন? জাতি হচ্ছে nation, আর জাত হচ্ছে caste. আরো খোলাসা করে বললে একটা জাতীয় পরিচয়, আরেকটা ধর্মীয়।

সমস্যা হলো শব্দগুলোর বিশ্লেষণ করলে দুটোরই একই অরিজিন পাওয়া যায়। লালন বলেছেন, “জাত কারে কয়?” কোনো কিছু থেকে উৎপন্ন বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘জাত’ শব্দটা, অর্থাৎ সেটা জন্ম ও বংশের সাথে সম্পৃক্ত। জাতের সাথেই বিভক্তি যুক্ত হয়ে এসেছে ‘জাতি’। তাহলে দুটো পরিচয়ের মধ্যে পার্থক্যকারী রেখাটা কোথায়? আরো দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, বংশসংশ্লিষ্ট ‘জাত’ এর ধারণাটা হিন্দুদের মাঝে থাকলেও, বংশের ভিত্তিতে রিলিজিয়াস স্টেটাস উঁচু-নিচু হওয়ার ধারণাটা ইসলামে নেই। হিন্দুধর্মের ইন্টার্নাল একটা বিষয়কে ব্যাপক অর্থে ধর্মীয় ভেদাভেদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু একটা জাত, মুসলিম একটা জাত। আর ভারতীয় বা বাঙালি হলো জাতি। নিশ্চিতভাবেই কবির উদ্দিষ্ট অর্থ শব্দগুলোর সত্যিকারের অর্থের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

জাতীয়তাবাদী সকল ন্যারেটিভই এরকম নানারকম স্ববিরোধিতা, পরস্পরবিরোধিতা আর সমাধানহীন ধাঁধায় পরিপূর্ণ।

৩.

কত বড় অবিচার! বেশিরভাগ দেশ একা একা ক্রিকেট খেলে। আর অস্ট্রেলিয়া পুরো মহাদেশ তুলে নিয়ে আসে! হ্যাটট্রিক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কি আর এমনি এমনি হয়েছে? শুধু তা-ই না। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া বনাম বিশ্ব একাদশের একটি ‘সুপার সিরিজ’ আয়োজন করে আইসিসি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লড়বে বিশ্বের ক্রিকেট পরাশক্তিগুলোর সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া একাদশ। তিনটি ওডিআই, একটি টেস্ট। ফলাফল?


প্রথম ওয়ানডে—অস্ট্রেলিয়া ৯৩ রানে জয়ী
দ্বিতীয় ওয়ানডে—অস্ট্রেলিয়া ৫৫ রানে জয়ী
তৃতীয় ওয়ানডে—অস্ট্রেলিয়া ১৫৬ রানে জয়ী
একমাত্র টেস্ট—অস্ট্রেলিয়া ২১০ রানে জয়ী!

তো এই মহাদেশ আজকের চেহারা কীভাবে পেল? কারা এর অধিবাসী?


ব্রেন্টন টেরান্টের দেশে

আদিকাল থেকেই আমরা, মানে উত্তর গোলার্ধের লোকেরা ভাবতাম দক্ষিণ গোলার্ধে নিশ্চয়ই একটা মহাদেশ আছে। ইউরোপীয়রা ল্যাটিন ভাষায় সেটাকে ডাকত ‘টেরা অস্ট্রালিস’, মানে ‘দক্ষিণা ভূমি’। খ্রিষ্টীয় ১৭ শতকে তারা বাস্তবেই ওই মহাদেশে যাওয়া শুরু করলে স্বভাবতই এই নামটিই আরোপিত হয়, যা থেকে পরে ‘অস্ট্রেলিয়া’ নামটা আসে।


ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা নতুন কোনো ভূমি খুঁজে পেলেই যেহেতু সেটাকে গ্রেট ব্রিটেনের অংশ বলে পতাকা বসিয়ে দেয়, ১৭৮৮ সালে তাই জেমস কুক আর আরথার ফিলিপ এ কাজই করলেন অস্ট্রেলিয়ার সাথে। ব্রিটিশরা প্রথমে ভেবেছিল মড়ার এই দ্বীপে মানুষজন থাকে না হয়তো। “কোনো মালিক নাই” (terra nullius) যুক্তিতে তাই সেটি হয়ে গেল ব্রিটেনের ‘কলোনি অব সেটেলমেন্ট’ (যুদ্ধের মাধ্যমে কলোনি করলে সেটা হতো ‘কলোনি অব কনকোয়েস্ট’)।

অ্যাবোরিজিনাল

অস্ট্রেলিয়ার ভেতরে ঢুকে ব্রিটিশরা দেখল সেখানে আদিবাসী মানুষদের বসবাস আছে! মানুষের অধিকার তো আর কেড়ে নেওয়া যায় না। তাই আদিবাসীদের মেরে-টেরে নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয় ব্রিটিশরা। একটি উদাহরণ হলো, ১৮২০-এর দশকে তাসমানিয়ান ব্ল্যাক ওয়ার, যার ফলে তাসমানিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তার ওপর ইউরোপ থেকে নিয়ে আসা বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম ইত্যাদি ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও আদিবাসীদের নেই, এটা কি ব্রিটিশদের দোষ? ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের পর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সংখ্যা ৮৪% কমে যায় বলে জানাচ্ছে উইকিপিডিয়া।

এই আদিবাসীদের বলে অ্যাবোরিজিনাল। নরমালের বিপরীত শব্দ অ্যাবনরমাল হলেও অরিজিনালের বিপরীত শব্দ অ্যাবোরিজিনাল নয়। বরং প্রায় সমার্থক। অস্ট্রেলিয়ার এই আদিবাসী অ্যাবোরিজিনালদের উৎপত্তি হলো বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নামে পরিচিত জায়গাটি থেকে। এখানকার অধিবাসীরা সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসতি গড়ে যা গবেষকদের ধারণামতে আজ থেকে প্রায় ৬৫,০০০ বা ৭০,০০০ বছর আগে।


পেনাল কলোনি

সব অপরাধীর জেলখানায় জায়গা হয় না। জেলখানা সবার পাওনাও নয়। তাই ব্রিটিশরা কিছু দাগী আসামীকে কামলা খাটতে পাঠিয়ে দিত অন্য কোনো কলোনিতে। সাজা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যেসব কলোনিতে পাঠানো হয়, সেগুলোকে বলে পেনাল কলোনি। উত্তর আমেরিকা একসময় ব্রিটিশদের পেনাল কলোনি ছিল। ১৭৮০ সালে আমেরিকানরা দুষ্টুমি (বিপ্লব) শুরু করলে নিরুপায় হয়ে আসামীদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাতে শুরু করে ব্রিটেন। ১৭৮৮ থেকে ১৮৬৮’র মধ্যে ১,৬১,৭০০ আসামী অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরিত হয়, যাদের মাঝে ২৫,০০০ নারী। বৈরী পরিবেশে প্যারা খেতে খেতে অপরাধীদের মরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু বিয়ার গ্রিলসের আদিপুরুষ কিছু অপরাধী পালিয়ে বনজঙ্গলে চলে যায় আর ডাকাতি করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এদের বলা হতো ‘বুশরেইঞ্জার্স’।

চোরাইপ্রজন্ম


মোটামুটি ১৯১০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল ও স্টেট গভর্নমেন্ট এজেন্সি এবং চার্চ মিশনগুলো কিছু কিছু মিশ্রবর্ণ আদিবাসী শিশুকে তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই শিশুগুলো অস্ট্রেলিয়ান অ্যাবোরিজিনাল এবং টেরাস স্ট্রেইট আইল্যান্ডার আদিবাসীদের বংশধর। স্থানভেদে কোথাও এক-দশমাংশ, কোথাও এক-তৃতীয়াংশ শিশু এভাবে অপহৃত হয়।


যুক্তি হলো, সাদাদের সংস্পর্শে আসার পর আদিবাসীদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে দিলে তারা একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তাদের শিশুদের তুলে এনে সাদাদের মাঝে কাজ করার ট্রেনিং দেওয়া হবে। বড় হলে সাদাদের সাথে বিয়ের মাধ্যমে তারা শ্বেতাঙ্গদের সাথে ‘assimilated’ হয়ে যাবে। সরকারিভাবে অপহৃত এই প্রজন্মগুলোকে বলা হয় Stolen Generations. পূর্বপুরুষদের এ আচরণের কারণে ২০০৮ সালে ফেডারেল পার্লামেন্টে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন তৎকালীন অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড।


ইতিহাসের অবিচ্ছিন্নতা

ইসলাম কখনো পিতার দোষে পুত্রকে দায়ী করে না। তবে ক্রাইস্টচার্চে মাসজিদে হামলার আসামী ব্রেন্টন টের‍্যান্ট ইতিহাসের কোনো বিচ্ছিন্ন চরিত্র নয়। সাদা, খ্রিষ্টান এবং ইউরোপীয়—যত পরিচয়ের সাথেই সে নিজেকে সংযুক্ত করে, জেনে-বুঝেই করে। পূর্বপুরুষদের কাজকর্মের কথা জেনে-শুনেই করে।

৪.

আগের পর্বে terra nullius শব্দ দুটো দেখেছিলেন। মনে আছে? যে জমি কারো নয়। সামনে প্রসঙ্গক্রমে আসতে পারে। পড়তে থাকুন…


দখলসূত্রে এ জমির মালিক জনাব অমুক

Things Fall Apart নামে একটি উপন্যাস আছে। সাদা চামড়ার দখলদাররা এসে কীভাবে কালোদের একটা ছিমছাম জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিল, তার গল্প। কালো মানুষদের ওই গোত্রটার (নাম ‘ইবো’) গোড়াপত্তন কীভাবে হলো, তার গল্প শুনুন। জায়গাটা আগে জঙ্গল ছিল। এই জঙ্গলের এক বন্য প্রেতাত্মার সাথে সাত দিন আট রাত যাবত মল্লযুদ্ধ করেন ইবো গোত্রের আদি পূর্বপুরুষ। প্রেতাত্মা পরাজিত হয়। তারপর সে জায়গায় বসতি স্থাপন করে বংশবিস্তার করেন তিনি। তারই বংশধর এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা।


এই বন্য আত্মার সাথে লড়াইয়ের ঘটনাটা আসলে ইবো-দের মাঝে প্রচলিত মিথ। আসল ঘটনা হলো জনাব পূর্বপুরুষ সাত দিন আট রাত যাবত বন জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করেছেন। গাছপালার ভেতরে তো আর বাড়ি করে মানুষ থাকতে পারে না। বসতির প্রয়োজনেই কিছু গাছ কেটে পরিবারের জন্য থাকার জায়গা তৈরি করেন তিনি।


বহু প্রজন্ম পর সাদারা এসে তাদের ভিটেমাটি দখল করেছে। তাই সাদারা দখলদার। কিন্তু কালো গোত্রটাকে এই terra nullius দিয়েছে কে? যখন এখানে জঙ্গল ছিল, এই জমির মালিক কে ছিল? ইবো পূর্বপুরুষ যে বনের প্রেতাত্মাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজে বসত গাড়লেন, তিনি কি দখলদার নন? বিরান পড়ে থাকা একটা ভূমিকে যে আগে গিয়ে দাবি করতে পারে, সে-ই কি সেই ভূমির বৈধ মালিক? তারপর উত্তরাধিকারসূত্রে তার সন্তানেরা?


তাহলে কি ভূমির ‘বৈধ’ মালিক বলে আসলে কেউ নেই? পূর্ববর্তী দখলদার, পরবর্তী দখলদারকে ‘অবৈধ’ বলে কেন চিহ্নিত করে?


দ্বৈতচেতনা

Things Fall Apart-এর লেখকের নাম চিনুয়া আচেবে। তিনি ইবো গোত্রেরই সন্তান। উপন্যাসটা লেখার সময় তিনি দ্বৈতচেতনায় (Double consciousness) ভুগতেন। চামড়ায় কালো, জাতিতে ইবো। কিন্তু ধর্মে খ্রিষ্টান, শিক্ষায় ইংরেজি শিক্ষিত। কলোনাইজড এবং কলোনাইজার—উভয়ের চেতনা তার মাঝে সমভাবে বিদ্যমান। কার পক্ষ হয়ে লিখবেন তিনি? উপন্যাসের নামটা তিনি নিয়েছেন এক বিখ্যাত আইরিশ কবির কবিতা থেকে। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের “The Second Coming”. কারণ আছে। ডব্লিউ বি ইয়েটস নিজেও দ্বৈতচেতনার রোগী। আইরিশ হিসেবে তিনি ইংলিশদের দ্বারা কলোনাইজড, আবার ব্রিটিশ হিসেবে বিশাল ভূখণ্ডের কলোনাইজার।

আচেবের ইবো পরিচয়ের চেয়ে বেশি বিখ্যাত পরিচয় হলো নাইজেরিয়ান পরিচয়। কিন্তু উপন্যাসটা যে সময়ের কাহিনী, সেসময় নাইজেরিয়ার অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে ছিল ইবো ছাড়াও আরো অনেক ছোট ছোট গোত্র। শাসনের সুবিধার্থে সাদারা এই পুরো অঞ্চল এক করে নাম দেয় নাইজেরিয়া। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই বিষয়টা ঝামেলা পাকিয়েছিল। প্রতিটা গোত্র আলাদা আলাদা আন্দোলন করবে, নাকি ‘নাইজেরিয়া’ নামে একটা ইউরোপীয় স্টাইলের জাতিরাষ্ট্র হয়ে আন্দোলন করবে? আলাদা আলাদা করলে সহজেই একটাকে আরেকটার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে মুক্তিসংগ্রাম ভণ্ডুল করে দেওয়া যায়। আবার একতাবদ্ধ হলে তো শোষকদের দেওয়া পরিচয়টাই মেনে নেওয়া হলো!


প্রতিটি ভূখণ্ড, প্রতিটি ‘জাতি’ এরকম হাজারো অমীমাংসিত রহস্য মনে পুষে রাখে। ভয়ে কারো সাথে আলোচনা করে না। পাছে ‘দেশ’ নামক পবিত্র সত্ত্বার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি হয়ে যায়!


ক্যারিবিয়ান নাইটস

আফ্রিকা তবুও অনেক ভালো জায়গা। ক্যারিবিয়ানের দিকে গেলে মাথার ভেতর জাতীয় পরিচয় গুবলেট পাকিয়ে মরণদশা হবে। সাদাদের দাস হয়ে বিভিন্ন প্ল্যান্টেশানে কাজ করার জন্য জাহাজে গাদাগাদি করে বিশাল বিশাল সাগর পাড়ি দিয়ে অনেক আফ্রিকান মানুষের এই দ্বীপগুলোতে আসা। তবে সবাই না। যারা এই মানবেতর পরিস্থিতি আর নানারকম রোগবালাই সহ্য করে পুরো পথ পাড়ি দিতে পেরেছিল, তারাই শুধু। বাকিরা তো জলের রাজ্যে লাশ হয়ে মিশে গিয়ে নতুন রকমের জাতীয় পরিচয় পেয়েছে। আদি ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকা থেকে আসা দাস আর কলোনি গেড়ে বসা সাদাদের মাঝে আবার বিয়েশাদি হয়ে জন্ম হয়েছে নানাজাতের মানুষের। নিজেদের অতীত ইতিহাস নিয়েই তাদের ব্যাপক সংশয়ে থাকা লাগে।


ডেরেক ওয়ালকট ছিলেন সেন্ট লুসিয়ার এমনই এক কবি, যিনি নিজের অতীতকে এক্সপ্লোর করতে গিয়ে প্রায়ই হিমশিম খেতেন। তার দাদা-নানা ছিলেন সাদা, আর দাদী-নানী ছিলেন কালো। আফ্রিকায় ফেলে আসা অতীত নিয়ে আর সবার মতো কাব্যিক হতে পারতেন না তিনি। এই সাদাদের অত্যাচার নিয়ে রেগে উঠছেন, তো পর মুহূর্তেই বিদ্রোহী নিগ্রোদের মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতার কথা ভেবে দমে যাচ্ছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কমই উদাহরণ আছে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত নিরপরাধ রক্ত থেকে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন ছিল। ওয়ালকটের ‘Ruins of a Great House’ নামক কবিতার কথক ঘুরে ফিরে দেখছিল কলোনাইজারদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত এক জমিদার বাড়ি। কত অত্যাচারিতের চিৎকার সেখান থেকে ভেসে আসছে, ভাবতে ভাবতে রাগটা উঠেই যাচ্ছিল তার। পরে মনে উঠল, কলোনাইজেশান আসলে গ্রেট ব্রিটেনের একার সম্পত্তি না, ধর্মীয় দাঙ্গা যেমন একা ভারতের না। কারণ, আলবিওন নিজেও একসময় কলোনি ছিল। আলবিওন হলো গ্রেট ব্রিটেনের পূর্ব নাম, যখন তা রোমান শাসকদের কলোনি ছিল!

৫.

বধে যে ব্যাধ, সেও যে বধ্য

ধর্মীয় ঐক্যকে ঠুনকো হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য উপমহাদেশের মানুষদের কমন একটি মন্ত্র শোনানো হয়। ভারত শাসন করার সময় ব্রিটিশরা এখানকার ধর্মীয় ভেদাভেদগুলোকে কাজে লাগিয়েছে। আমরা পপুলার ডিসকোর্সে শুনে এসেছি যে, জাতীয়তা আর ধর্মের এই ক্রাইসিস ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব সম্পত্তি। পৃথিবীর আর কোথাও মানুষ ধর্ম নিয়ে এমন ‘বাড়াবাড়ি’ করে না। দুই বাংলার বিভেদ, কাশ্মীর সমস্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ’৭১ এর গণহত্যা—কী নেই এখানে? আসলে ব্রিটেন নিজেও এই সমস্যায় জর্জরিত ছিল, এখনো আছে।


ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওয়েলস মিলে ছিল গ্রেট ব্রিটেন। সবাই ছিল ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের শাসনাধীনে। অর্থাৎ মুরুব্বির স্থানটা ইংল্যান্ডের দখলে। আয়ারল্যান্ড দীর্ঘদিন স্বাধীনতা আন্দোলন করেছে। এর মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত ইংল্যান্ড থেকে ক্যাথলিক অধ্যুষিত আয়ারল্যান্ডকে মুক্ত করার চেতনা।

চার্লস স্টুয়ার্ট পার্নেল নামে আইরিশদের এক ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছিলেন, আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো। তার হাত ধরে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলন দ্রুতবেগে বেশ কিছু দূর এগিয়ে যায়। তারপর আসে আঘাত। এক নারীর সাথে পার্নেলের পরকীয়া সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে যায়। এমন একজন মানুষের নেতৃত্বে ক্যাথলিকদের মুক্তিসংগ্রাম চলতে পারে না, ধর্ম সবার আগে। চার্চ তাকে কন্ডেম করে। অনুসারীদের বড় একটা অংশ তার বিরুদ্ধে চলে যায়। মানসিক চাপ সইতে না পেরে পার্নেলের মৃত্যু হয়।

একজনের ব্যক্তিগত বিষয়কে কেন্দ্র করে পুরো একটা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন স্থবির করে দেওয়াটা মানতে পারেনি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী আইরিশরা। চার্চপন্থীদের সাথে তাদের অভ্যন্তরীণ একটা দ্বন্দ্ব লেগে যায়। অনেক পিছিয়ে যায় স্বাধীনতা আন্দোলন। আয়ারল্যান্ড শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড নামে প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত একটা অংশ মূল আইরিশ ভূখণ্ড থেকে পৃথক হয়ে গ্রেট ব্রিটেনের অধীনে থেকে যায়।

© আশিক আরমান নিলয়
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *