চিন্তালাপ

পাগলের ধর্ম! — আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক

যত দূর মনে পড়ে ঘটনাটি পড়েছিলাম বিশ্ববরেণ্য লেখক সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভীর রচিত কোনো একটি বইয়ে। তখন ভারতবর্ষে চলছিল বৃটিশ শাসন। এক এলাকায় হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে একটি জমি নিয়ে তুমুল দ্বন্দ্ব। মুসলমানদের দাবি এটি তাদের জায়গা, এখানে তারা মাসজিদ নির্মাণ করতে চায়। হিন্দুদের দাবি এটি তাদের জমি, এখানে নাকি পূর্বযুগে মন্দির ছিল। তারা এটি দখলে নিয়ে মন্দির পুনঃনির্মাণ করতে চায়। মনস্তাত্বিক দিক থেকে দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চূড়ান্তপর্যায়ে পৌঁছে গেছে; এখন কেবল তা মাঠে গড়ানো বাকি। আর তা হয়ে গেলে রায়ট লেগে যেতে পারে। বাপক হতাহতের আশঙ্কা।


বিলেতি প্রশাসক চিন্তিত। বিচারক কোনো কূল-কিনারা করে উঠতে পারছেন না। শেষ উপায় হিসেবে তিনি দু’পক্ষকে ডেকে বললেন তোমরা এমন কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এসো যার সাক্ষী তোমাদের উভয় পক্ষ গ্রহণ করবে। মজার ব্যাপার হলো হিন্দুরা যে ব্যক্তিকে সাক্ষী মানলো তিনি একজন মুসলিম এবং বয়সে বেশ প্রবীণ। যেহেতু হিন্দুরাই তাকে সাক্ষী মেনেছে, অগত্যা মুসলিমদের তা মেনে নিতেই হলো।


মাননীয় জাজ সাহেব সেই ব্যক্তিকে কোর্টে তলব করে চিঠি পাঠালেন, কিন্তু তিনি কোর্টে আসতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাকে বারবার তলব করার পর জানা গেল যেল যে, তিনি কসম করেছেন জীবনে আর কখনো ভারতবর্ষ দখলকারী কোনো ফিরিঙ্গির চেহারা দেখবেন না। এ কারণে তার পক্ষে কোর্টে আসা সম্ভব নয়। জাজ সাহেব সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাকে বিষয়টি বিবেচনার জন্য নিবেদন করেন এবং জানান যে, কোর্ট তাকে যে-কোনো রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত। কোর্টের মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি জানান যে, তিনি একশর্তে কোর্টে আসতে পারেন। তাকে কোর্টে পেছন ফিরে প্রবেশের এবং বিচারকের দিকে পশ্চাতমুখী হয়ে কথা বলার অনুমতি দিতে হবে, যাতে তিনি সাক্ষ্যও দিতে পারেন এবং ফিরিঙ্গির চেহারা দর্শন থেকেও নিজেকে বাঁচাতে পারেন।



কোর্ট পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে তার দাবি মেনে নেয়।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তিনি এসে সাক্ষ্য দেন যে, যমিটি মুসলমানদের নয়, বরং হিন্দুদের। কোর্ট যমিটির ওপর হিন্দুদের মালিকানা প্রদান করে ঠিকই, তবে সেই প্রবীণ মুসলিম ব্যক্তির সততা ও নিরপেক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে এলাকার প্রায় সব হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণ করে ফেলে এবং সেখানে তারাই একটি মাসজিদ নির্মাণ করে।


আসলেই নিরপেক্ষতা ব্যাপারটি জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই একটি প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। নিরপেক্ষ ব্যক্তির প্রতি মানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধা থাকে; কারণ, মানুষের কাছে নিরপেক্ষতার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু তথাপিও, বাস্তবতা হলো, নিরপেক্ষতা বিষয়টি আসলে কী তা অধিকাংশ মানুষই সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন না। ঘটনাটিকে সাদাচোখে দেখলে প্রথমে আমাদের মনে হবে, লোকটি কত নিরপেক্ষ! কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে ভদ্রলোক কিন্তু মোটেই নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেননি; বরং একটি পক্ষ অবলম্বন করেছেন।

আমরা এটাকেই নিরপেক্ষতা ভাবতে এবং বলতে পছন্দ করি এবং বলি। বাস্তবতা হলো নিরপেক্ষতা বলতে আসলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। নিরপেক্ষতার শাব্দিক অর্থ হলো কোনো পক্ষ অবলম্বন না করা। যেখানে ন্যায়-অন্যায় আছে, সত্য-মিথ্যা আছে, সেখানে আপনি যদি বলেন আমি কোনো পক্ষে নই, আমি নিরপেক্ষ—তাহলে তা নিরেট শয়তানি ছাড়া কিছুই নয়। এর দ্বারা মিথ্যার প্রতি মৌন সম্মতি দেওয়া হয়, পরোক্ষভাবে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। গ্রামাঞ্চলে এমন চুপ থাকা লোককে মিনমিনে শয়তান বলা হয়। নিরপেক্ষতার কোনো ফলিত রূপ নেই। এটা একটি প্রতারণামূলক শব্দ। আমরা যেটাকে সত্যি নিরপেক্ষতা বলি সেটা মূলত সত্য-ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করা। আবেগ-অনুরাগ, রাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে ন্যায়ানুগভাবে সত্যের পক্ষ অবলম্বন করা। জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সত্যকে সমর্থন দেওয়া।


সত্যিকার নিরপেক্ষতার এ প্রসঙ্গ আল্লাহর কালামেও এসেছে। তিনি বলেছেন “তোমরা আল্লাহর জন্য সাক্ষী হয়ে সত্য-ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাও”। আল্লাহর কালামের উদ্দেশ্য যেহেতু মানুষকে জীবনপথে চলার বাস্তব নির্দেশনা প্রদান, তাই এখানে তিনি তার বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। ‘নিরপেক্ষ হও’ বলে তিনি মানুষকে বিভ্রান্ত করেন না। তিনি সোজা-সাপটা বলে দেন ‘সত্যের পক্ষে দাঁড়াও’।

সার কথা, নিরপেক্ষতার প্রকৃত ও ফলিত অর্থ হলো সত্যের পক্ষ অবলম্বন করা। এ যুক্তির ভিত্তিতে আমরা দাবি করতে পারি—বাংলা শব্দ ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক শাব্দিক অর্থ হলো সত্য ধর্মের পক্ষ অবলম্বন করা—আর অবধারিতভাবে তা হলো ইসলাম ধর্ম বা ইসলামি জীবন-ব্যবস্থা।
আমার এ যৌক্তিক ব্যাখ্যা যদি কেউ গ্রহণ না-ও করতে চান সে স্বাধীনতা তার আছে। কিন্তু যে অধিকার কারোও নেই তা হলো ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা। পৃথিবীর জীবনে মানুষকে যে সীমিত স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তাতে সে যেকোনো মতবাদ গ্রহণ করতে পারে। নিজ মতের দিকে অন্যকে আহ্বান করার ব্যাপারটিকে আইন কিংবা অধিকার দিয়ে বিচার করা ভুল; কারণ এটা মানুষের প্রকৃতি। মানুষ নিজে যা বিশ্বাস করবে সে অন্যকে তা গ্রহণের দিকে আহ্বান জানাবে এটাই স্বাভাবিক। সে চাইবে পৃথিবীর সব মানুষ তার মতো একই বিশ্বাস ধারণ করুক। সেহেতু যারা সেক্যুলারিজমকে তাদের ধর্মাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবেন তারাও তা-ই চাইবেন; এটাই স্বাভাবিক। আদর্শের নির্ভুলতা কিংবা সঠিকতা মানুষকে আদর্শবাদিতার সার্টিফিকেট দেয় না। কোনো আদর্শ সঠিক না ভুল সেটাও এক ভিন্ন আলোচনা। এখানে বিষয় আদর্শের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা নয়, আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠতা, সততা ও বিশ্বস্ততা। কেননা, আদর্শের প্রতি সততাই একজন মানুষকে সত্যিকার শুদ্ধ আদর্শবাদী করে তোলে।

যেটা করা একান্তই অনৈতিক, নীচতা, কপটতা ও ভণ্ডামো- তা হলো মানুষের সাথে আদর্শিক ব্যাপারে প্রতারণা করা। নিজ আদর্শের ব্যাপারে অসততা অবলম্বন করা; আদর্শকে ধান্দাবাজির হাতিয়ার বানানো; আদর্শিক ব্যাপারে মানুষকে গোঁজামিল দেওয়া, ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করা।

ঠিক এই জায়গাতে যারা মুসলমান-বিশেষত বাঙ্গালিদের মধ্যে যারা নিজেদের সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন তাদের অল্প কিছু বাদে বাকি সকলকে আমার কাছে রাজনৈতিক বেশ্যা, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক বলে মনে হয়। কারণ, তারা এই জাতির কাছে কখনোই সত্যিকার সেক্যুলারিজম কী তা প্রকাশ করার সাহস পাননি। সবসময়ই সাধারণ মানুষকে মুখরোচক শব্দের মারপ্যাঁচে বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন; প্রতারণা করেছেন এবং হীন রাজনৈতিক স্বার্থে সেক্যুলারিজমকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের আড়ালে রেখে ব্যবহার করেছেন।

ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, উৎপত্তি, ক্রমবিবর্তন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ইত্যাদি আলোচনায় না গিয়ে আমি ছোট্ট একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাই। কারণ, ধূর্ত রাজনৈতিক পতিতারা সেক্যুলারিজমের যে মিথ্যা অর্থ করেছে সেখানে তারা নিজেরাই ধরা খেয়েছে।

বিরোধীদল কর্তৃক একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির নেতৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের একজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন—‘কেবল শিশু ও পাগলরাই নিরপেক্ষ।’


নির্বাচনের মতো একটি নিরাবেগ বিষয়েই যদি মানুষ নিরপেক্ষ হতে না পারে তাহলে ধর্মের মতো গভীর আবেগপূর্ণ বিষয়ে কীভাবে মানুষ নিরপেক্ষ হতে পারে? একটি দেশের নির্বাহী প্রধানের পদে বহাল থাকা অবস্থায় এবং রাজনৈতিক বিতর্কে বক্তব্য প্রদানের প্রেক্ষাপটে করা তার মন্তব্যের অবশ্যই তাত্ত্বিক ও আইনগত গুরুত্ব রয়েছে বলেই যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষ মেনে নেবেন।

অতএব, কেবল পাগল ও শিশুরাই যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে অবধারিতভাবে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী দাবিদার প্রত্যেক ব্যক্তি হয় পাগল নয়ত শিশু। কাউকে শিশু বলার ব্যাপারটি যেহেতু একটি সুনির্দিষ্ট বয়সের সাথে সম্পৃক্ত, সেহেতু কেবল পাগল বিশেষণটিই তাদের জন্য থেকে যায়।

এ সমীকরণের আরেকটি অবধারিত ফল হলো কোনো দেশের সংবিধানের একটি মৌলিক স্তম্ভ যদি থাকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তাহলে সেই সংবিধানের প্রতি কেবল পাগলদের পক্ষেই আস্থা রাখা সম্ভব!

© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *