চিন্তালাপ

মাসজিদ হোক জ্ঞানকেন্দ্র — ওমর আলী আশরাফ

মাদানীনগর মাদরাসায় পড়ি তখন। দরসি লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে আমরা সাহিত্য আসর করতাম, পাঠচক্রে বসতাম। নিয়মিত দেয়ালিকা লিখে টাঙাতাম। বাংলা, আরবি, ইংরেজি দেয়ালিকা। মাদরাসার পক্ষ থেকেই বক্তৃতা, সাহিত্য ও বইপাঠে আমাদের উৎসাহ দেওয়া হতো। প্রতি বৃহস্পতিবারে বক্তৃতা-শেখা অনুষ্ঠানে যোগদান ছিল বাধ্যতামূলক।

আমরা পাঠচক্র, দেয়ালিকা তৈরি, এ সংক্রান্ত মাশওয়ারা ইত্যাদি মাসজিদে বসে করতাম। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে পুরো মাদরাসাব্যাপী বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান হতো মাসজিদের দ্বিতীয় তলায়। হুযুররা থাকতেন অতিথি ও বিচারক।

মাদরাসাগুলো ব্যতীত দেশের অন্য মাসজিদগুলো খেয়াল করুন তো একবার! কয়েক মাস আগে বাইতুল মুকাররমে আমরা তরুণরা একটি ইসলামি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে গোল হয়ে বসলাম, খাদেম এসে হম্বিতম্বি করে উঠিয়ে দিল। আজ-কাল আমাদের দেশের মাসজিদগুলোতে শুধু ফরজ নামাযের সময়ে গেইট খোলা থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর নামায, তালিম ছাড়া তেমন কোনো ধর্মীয়, সামাজিক, বিদ্যাকেন্দ্রিক আসরের সুযোগ থাকে না।

মাসজিদ শুধু নামায আর যিকির নয়, হয়ে উঠুক ইবাদাতের অন্যতম অনুষঙ্গ জ্ঞানেরও কেন্দ্র। ফরজ নামাযের পর মাসজিদের গেইট বন্ধ হয়ে যাবে না, কেউ তিলাওয়াত করবে; যার খুশি বই পড়বে। প্রত্যেকটা মাসজিদের একটি কোনা হয়ে উঠুক একেকটি লাইব্রেরি। শুধু মাসআলা-মাসাইল নয়, ইসলাম-প্রাসঙ্গিক সমস্ত বই থাকবে। টাইলসের প্রতিযোগিতা নয়, মাসজিদে মাসজিদে হোক বই রাখার প্রতিযগিতা। কার সংগ্রহের ভান্ডার কত বড়, কে কতজন ভাইকে বইপাঠে উদ্বুদ্ধ করেত পেরেছে, তার প্রতিযোগিতা হোক। সপ্তাহে সপ্তাহে পাঠচক্র বসুক, অনুষ্ঠান হোক। ফরজ ইবাদাত কার একবেলাও ছোটেনি, সুন্নাতে কার কতটুকু উন্নতি হলো, তিলাওয়াত-বইপাঠে কে কত অগ্রসর, এসবের মুহাসাবা হোক। ইমাম সাহেব হবেন তদারকদের একজন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রকল্প ছিল, মাসজিদভিত্তিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজে অতীতে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। একে আরো সমৃদ্ধ করা, যেখানে তারা পৌঁছাতে পারেননি, সেখানে গণপাঠাগার রচনা করা আমাদের সামাজিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত।

রাসূলুল্লাহর মাসজিদে নববিতে জ্ঞানের চর্চা ছিল। আহলুস সুফফাহর সদস্যগণ শুধু নামায-তাসবিহই জপেননি, রাসূলের সাহচর্যে থেকে এসব ইবাদাতের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং দূর-দূরান্তে তা দায়িত্ব নিয়ে বিলিয়েছেন। রাসুল ও খুলাফাদের মাসজিদ ছিল সব সমস্যার সমাধান কেন্দ্র। বিচারের কাঠগড়া, অসহায়ের সংস্থান, হৃদয়ের প্রশান্তকরণ। আমাদের মতো কেবল ফরজ নামায আর জুমাআর বয়ানে তাদের মাসজিদ সীমাবদ্ধ ছিল না।

আমাদের মাসজিদে যদি পর্যাপ্ত বই থাকে, পরিচর্যা ও তত্ত্বাবধান করেন সমঝদার ব্যক্তিরা, এতে—

  • যাদের কিনে বই পড়ার তাওফিক কম হয়; কিন্তু পাঠের তৃষ্ণা অনেক, তাদের হৃদয়ের খোরাক হবে।
  • যে ছেলে করার কিছু না পেয়ে মোবাইলের গেইমে সময় অপচয় করে এবং মেধা বরবাদ করে, তার দ্বারা জ্ঞানচর্চা হবে।
  • পুরো এলাকা হয়ে উঠবে শিক্ষিত সমঝদার ও পরিশীলিত প্রজন্ম।
  • মাসজিদে লাইব্রেরি হলে কোথাও ঘর ভাড়া করে লাইব্রেরি করার খরচ বেঁচে যাবে। এলাকার মান্য-গণ্যরা ডোনেশনে আগ্রহী হবেন। মাসজিদের জন্য বই দিতে গিয়ে নিজের জন্যও কিছু কিনে নেবেন।
  • মাসজিদ সাজবে অপূর্ব সাজে। টাইলসের যে সজ্জা, বইয়ের ঘ্রাণ ও সৌন্দর্য পূর্ণতা দেবে তার চেয়ে দ্বিগুণ। এতে মুগ্ধ হয়ে যাদের সহায় আছে, অনেকেই নিজের জন্য বই কিনতে ও ঘরে সাজাতে আগ্রহী হবে।
  • জ্ঞানের আদান-প্রদানে অনাচার-অযাচার তুলনামূলক হ্রাস পাবে।
  • ধর্মীয়, বিচারিক, প্রশাসনিক-সহ নানান জিজ্ঞাসার জবাব মানুষ নিজেরাই খুঁজে বুঝে নিতে পারবে।

জ্ঞানের জন্য কুরআনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, হাদিসে নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা উভয়ে কি সমান?’

বদরের যুদ্ধে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে অসামর্থ্য বন্দিদের আল্লাহর রাসূল মুক্তি দিয়েছেন বন্দি প্রতি ১০জন করে মুসলিম শিশুকে শিক্ষা দেবার শর্তে। ১০জনকে লেখাপড়া শেখালেই মুক্তি! সেই রাসূলের উম্মত আমরা জ্ঞানের প্রতি কত অনাগ্রহ!

আবার সেই সোনালি কাল ফিরে আসুক। ঘরে-দুয়ারে জ্ঞানের চর্চা হোক। সমাজ পরিচালনা করুক কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানীরা। বিচারের আসর বসুক মাসজিদের চাতালে। সবকিছুর কেন্দ্র হোক মাসজিদ। আমরা মাসজিদমুখিতার কথা বলি। মাসজিদমুখিতা বলতে কি শুধু নামায বোঝায়? ন্যায়বিচারের জন্য মানুষ মাসজিদমুখী হোক, সমাজের সমস্ত ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত আসুক মাসজিদের মিম্বার থেকে। জ্ঞানের পসরা বসুক মাসজিদের দহলিজে। সর্ববিষয়ে মানুষ হোক প্রকৃত মাসজিদমুখী।

  • নোট : যারা মাসজিদে লাইব্রেরি করার কথা ভাবছেন, আপনাদের কাজ হোক পরিকল্পনামাফিক। বই কেনা, সাজানো, পাঠক তৈরি, পাঠের পরিবেশ-সহ সবকিছু গোছানো হোক। ঢাকা থেকে বই সংগ্রহে যদি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, সিয়ান আপনাদের সঙ্গে আছে, ইনশা আল্লাহ।

© ওমর আলী আশরাফ
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *