প্রথমে যে বিষয়টির প্রতি আমাদের সচেতন হওয়া দরকার, তা হলো সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যে আল্লাহর ইবাদাতের এসেন্সটাকে উপলব্ধি করা। সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো থেকে তো আমাদের ইবাদাত সেন্স প্রায় উঠেই গেছে বলা চলে।
আজকাল মেহমানদারি, ক্ষুধার্তকে অন্ন দান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা—এসব কাজকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করার দ্বারা এগুলোকে প্রত্যক্ষ ইবাদাতে রূপান্তরিত করার যে কালচার মুসলিমদের মধ্যে ছিল, সেটা খুবই অনুপস্থিত। ইল্লা মা শা আল্লাহ এগুলোকে এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পর্যবসিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থের কারণেই আজকাল মানুষ এ ধরনের কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করে। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণের হার খুবই কম।
এখন ফিতনা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যে কাজগুলো ছিল পিওর রিচুয়ালস বা একান্তই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সেগুলোও সামাজিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করে সামাজিক কর্মকাণ্ডের অনুষঙ্গ হিসেবে। রোজার মতো একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজটিও পরিণত হয়েছে লোকদেখানো আচারে। উদ্ভাবন হয়েছে ‘সেহরি পার্টি’-এর মতো অভিনব মৌজমাস্তিসর্বস্ব অনুষ্ঠানের।
আমাদের সামনে আসন্ন কুরবানি। আমরা একটু বুকে হাত দিয়ে বলি তো—এই কুরবানি সংশ্লিষ্ট কতটুকু কাজ আমরা সত্যিকার এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের অনুভূতি নিয়ে করি!
যা হওয়ার এতদিন হয়েছে। আসুন এবার আমরা একটু সচেতন হই। প্রথমে আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করি। এবার আমরা এই দিনে কী কী করব তা নির্ধারণ করব আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী এবং যা যা করব তা করব কেবলই, একমাত্র, শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
করণীয়গুলো জানার আগে আমাদের জানতে হবে আসলে এই দিন কেন গুরুত্বপূর্ণ। তার আগে জানতে হবে কোনো দিনকে গুরুত্বপূর্ণ বা মর্যাদাপূর্ণ ঘোষণা করার অধিকার একমাত্র তিনিই রাখেন, যিনি দিন সৃষ্টি করেছেন, যিনি রাত সৃষ্টি করেছেন। তিনি ছাড়া অন্য কারও কোনো অধিকারই নেই কোনো দিনকে মর্যাদাপূর্ণ ঘোষণা করার।
এই দিনের স্রষ্টা মহান আল্লাহ এই দিনকে কুরআনুল কারিমে ‘ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবর’ বা শ্রেষ্ঠ হাজ্জের দিন ঘোষণা করেছেন। এই দিনেই হাজিগণ তাদের পশু কুরবানি করে হাজ্জের প্রধানতম আনুষ্ঠানিকতাসমূহ পূর্ণ করেন।
ইবনু ‘উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন দিন? সাহাবিগণ উত্তর দিলেন, এটা ইয়াওমুন্নাহার বা কুরবানির দিন। রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা হলো ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হাজ্জের দিন। [আবু দাউদ, ১৯৪৫ সহিহ]
দ্বিতীয়ত এই দিন বছরের শ্রেষ্ঠতম দিন। আবদুল্লাহ ইবনু কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহর নিকট সকল দিনের মাঝে শ্রেষ্ঠতম দিন হলো কোরবানির দিন, তারপর তার পরবর্তী তিনদিন। [আবু দাউদ, হাদীস–১৮৬৫ সহিহ]
কুরবানির দিনের করণীয়
ঈদের সালাত আদায় করা:
আমাদের সমাজের অনেক মানুষ আছেন, যারা নিয়মিত সালাত আদায় করেন না, তবে ঈদের সালাতের জন্য ঈদগাহে যান। তাদের জন্য একটি আত্মজিজ্ঞাসা—এই সালাতটা আপনি কেন পড়ছেন? যদি আল্লাহর জন্য পড়ে থাকেন, তাহলে সেই আল্লাহ যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন, সেটা এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এখন যদি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতি কোনো গুরুত্ব না থাকে, তাহলে আপনি কি নিজেকে বোঝাতে পারবেন, যে এই ঈদগাহে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এসেছেন?
ঈদগাহে যাওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা:
এটা আল্লাহর রাসূলের একটি সুন্নাহ। অত্যন্ত প্রিয় সুন্নাহ। দুনিয়ার যে কটি জিনিস তিনি তাঁর প্রিয় বলে উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে এটি একটি।
পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা:
এটা সবসময়ের জন্য করণীয় হলেও এই সময়ের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যারা কুরবানি করবেন তারা যেহেতু বিগত নয় দিনে নখ-চুল-গোঁফ কাটতে পারেননি, তাই ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করে নেবেন।
সুন্দর পোশাক পরিধান করা:
উত্তম পোশাক পরিধান; যদি কারও ‘সম্মানে’ পরিধান করা হয়, তাহলে সেটা তো কেবল পোশাকের স্রষ্টা মহান আল্লাহর সম্মানেই হওয়া উচিত। আল্লাহ এটা অত্যন্ত পছন্দ করেন, বান্দা যেন তাঁর ইবাদাতের সময় উত্তমরূপে নিজেকে সজ্জিত করে। এজন্য তিনি কুরআনুল কারিমে বলেছেন—হে বনু আদাম, প্রত্যেক ইবাদাতের সময় তোমাদের উত্তম সাজসজ্জা গ্রহণ করো। আমরা যদি পৃথিবীর কোনো রাজাবাদশা বা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানেও যাই, সাধ্যমতো উত্তম পোশাকে যেতে চেষ্টা করি। তাহলে মহান রবের সামনে দাঁড়াতে, তাঁর আমন্ত্রিত অনুষ্ঠান ঈদের সালাতের জন্য এই আগ্রহ সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। তবে এটা যে নতুন কাপড়েই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কাছে থাকা কাপড়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো কাপড়টি হলেই হয় এবং তা পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হলেই চলে।
ভিন্ন পথে ঈদগাহে আসা-যাওয়া:
ইসলামের হুকুম-আহকাম কিংবা নবিজির প্রতিটি সুন্নাহর মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কখনো এ কল্যাণ আমরা অনুধাবন করতে পারি, কখনো পারি না। হয়তো এই সুন্নাহর মধ্যে কী তাৎপর্য আছে তা সকলের কাছে, কিংবা কারও কাছেই স্পষ্ট নাও হতে পারে। তবে আমালটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটি একটি সুন্নাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে এক পথ দিয়ে যেতেন, আসতেন অন্য পথ দিয়ে।
ঈদুল আযহার সালাতের পূর্বে কিছু না খাওয়া:
ঈদুল ফিতরের দিন সালাতের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কিছু খেয়ে যাওয়া সুন্নাহ। মিষ্টি জাতীয় কোনো খাদ্য বা সহজলভ্য যেকোনো খাবার। খেজুর খেয়ে যাওয়া যেতে পারে; আর সেক্ষেত্রে খেজুর বেজোড় সংখ্যায় হওয়া উত্তম। পক্ষান্তরে ঈদুল আযহার দিনে সালাত আদায় করে আসার পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু খেতেন না। তিরমিযির বর্ণনায় এসেছে, ঈদের সালাত আদায় না করা পর্যন্ত; আর সহিহ ইবনু হিব্বানের বর্ণনায় এসেছে, কুরবানি না করা পর্যন্ত কিছু খেতেন না।
তাকবির পাঠ করা:
ঈদের সালাতে যাওয়া-আসার সময় এবং সাধারণভাবে যেকোনো সময়ে অধিক হারে তাকবির পাঠ এই দিনের একটি বিশেষ আমাল। তাকবির হলো: আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ।
কুরবানির পশু জবাই করা ও তার গোশত আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব ও দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা।
যা করবেন না:
অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, পৌত্তলিক বিধর্মীদের মতো আজকাল আমাদের ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানগলো পরিণত হয়েছে পাপাচারের উপলক্ষ্যে। পাড়ামহল্লার মোড়ে মোড়ে বিকট শব্দে অশ্লীল গানবাজনা, বেপর্দা অর্ধনগ্ন অবস্থায় নারীদের রূপের পসরা সাজিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি তো খুবই সাধারণ দৃশ্য। আল্লাহ যে দিনগুলোকে বিশেষভাবে তাঁর আনুষ্ঠানিক ইবাদাতের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন, সেই দিনগুলোতে আরও প্রকটভাবে তাঁর অবাধ্যচারিতা আমাদের ভয়ানক শাস্তির উপযুক্ত করে তোলে। এই শাস্তি থেকে বাঁচতে নিজেরা সচেতন হই, অন্যদেরকেও সচেতন করে তুলি।
© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান