চিন্তালাপ

গর্ভকালীন ক্লাস, এখনও কী সময় হয়নি? —রাবেয়া রওশীন

২০১৩ সালের শেষ দিকে আমার বিয়ে হয়। এখন পর্যন্ত আমার তিন সন্তান আলহামদুলিল্লাহ। এটা আমার সৌভাগ্যই বলা যায় যে, তিন জনের দুজনই উন্নত দেশে জন্মগ্রহণ করেছে।

সৌভাগ্য এই কারণে বলছি না যে, সেসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা আমাদের চেয়ে খুব উন্নত। কারণ স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হলেই ভালো প্রসবের অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যের পাশাপাশি নিজের জ্ঞান ও প্রস্তুতিও অপরিহার্য। এর উদাহরণ আমি নিজেই। নিজের অজ্ঞতার কারণে প্রথমবার মা হওয়ার সময় আমাকে ও আমার সন্তান, দুজনকেই ভুগতে হয়েছিল।

সৌভাগ্য এজন্যই বলছি যে, সেসব দেশের মেয়েরা মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের চেয়ে বেশি সচেতন এবং তাদের মাধ্যমে আমার মাঝেও এর প্রভাব পড়ে। ন্যাচারাল বার্থ বা প্রাকৃতিক প্রসব কেমন হতে পারে, জন্মের ঠিক পর পর নবজাতকের প্রতি প্রাথমিক সেবা কেমন কোমল হওয়া উচিত— সে নিয়ে ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা হয়েছে সেসব দেশের স্টাবলিশড মিডওয়াইফারি সিস্টেমের কল্যাণে। সবচেয়ে বড় কথা আমি একটা চলমান বিবাদের সমাধান পেয়েছিলাম।

বিবাদটা হচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশে ডাক্তার ও রোগীদের পারস্পরিক বিরোধ। ফেসবুকের কল্যাণে যেকোনো বিষয়ের বাগ্‌বিতণ্ডা এখন জনসম্মুখে নিয়ে আসা যায়। প্রথমবার যখন মা হতে যাচ্ছিলাম, তখন থেকেই দেখেছি মা হতে গিয়ে যারা ভুক্তভোগী, তারা প্রায়ই ডাক্তারদের দোষারোপ করছেন। এদিকে ডাক্তাররাও তাদের দিক থেকে বারংবারই রোগীদের অজ্ঞতার বিষয়গুলো তুলে আনছেন। সেই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারির সংখ্যা নিয়েও দু-পক্ষেই বিতর্ক অব্যাহত আছে। স্পষ্টতই এখানে একটা শূণ্যতা বিরাজমান।

সেটা গর্ভকালীন ক্লাস বা প্রসবসংক্রান্ত শিক্ষা। আমাদের সমাজে এই শব্দগুলো একদমই নতুন বলা যায়; কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে প্রচলিত এই ধারণা উন্নত বিশ্বে এখন খুবই জনপ্রিয়। মূলত সেখানের মেয়েরা সন্তান প্রসব করতে যেসব জ্ঞান থাকা আবশ্যক, তা সুপরিকল্পিতভাবে সাজানো ক্লাস করার মাধ্যমে না জেনে নিয়ে লেবার রুমে যাওয়াকে বোকামি মনে করে। কথাটা আরেক ধাপ এগিয়ে যদি বলি, তাহলে বলতে হয়—যে সন্তান প্রসব করতে ও মাতৃত্বের যাত্রার সূচনাতে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জনে যা যা প্রয়োজন, সেই জ্ঞান আহরণ করেই এই পথে হাঁটতে শুরু করা তাদের সংষ্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে।

একজন নারী হিসাবে বলতে পারি, সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা ও নবজাতক সন্তানের সঙ্গে প্রাথমিক বন্ধন স্থাপনের গুরুত্ব আমাদের জীবনে অসীম। এর প্রভাব আজীবন আমাদের মনে রয়ে যায় এবং এ অভিজ্ঞতা আমাদের ব্যক্তিত্বেও প্রভাব ফেলে। এই অভিজ্ঞতা যদি সুন্দর হয় ও তাতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা থাকে, তাহলে তা আমাদের মানসিকভাবে আরও দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। মায়ের মানসিক সুস্থতা তার শিশুকে ছাড়িয়ে পুরো পরিবারের ওপরও প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতায় মা নিজেকে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় একজন ভিকটিম ভাবতে শুরু করেন, তার মানসিক অবসাদ তার শিশুকে ছাড়িয়ে পুরো পরিবারকেও প্রভাবিত করে এবং এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা তখনই একজন মা নিতে পারেন যখন তিনি এই বিষয়ে ভালোভাবে জ্ঞান রাখেন।

জ্ঞান অর্জন ও প্রস্তুতির আলোকে দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সময় নিজের চমৎকার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের এই বিষয়ে জানানোর আন্তরিক তাগিদ অনুভব করি। আর তাই এই বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান AMANI Birth‐এর মাধ্যমে আরও জেনে অন্য মেয়েদের জানানোতে আমি পরবর্তী সময়ে উদ্বুদ্ধ হই। বর্তমানে রৌদ্রময়ী স্কুল থেকে আয়োজিত দেশের প্রথম অনলাইন প্রিনাটাল ক্লাসের মাধ্যমে হবু মায়েদের ও তাদের স্বামীদের লেবার ও ডেলিভারির মতো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ অবহেলিত বিষয়ে জানার সুযোগ করে দিতে পারছি, আলহামদুলিল্লাহ।

রৌদ্রময়ী প্রিনাটাল কোর্স থেকে প্রতি ব্যাচেই ভালো কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে, আলহামদুল্লিল্লাহ। যেসব মায়েরা এই বিষয়ে গভীরভাবে জানার গুরুত্ব উপলব্ধি করে কোর্সে জয়েন করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে সেই জ্ঞান বাস্তবে আন্তরিকভাবে প্রয়োগ করেছেন, তারা নিজেদের সফলতার গল্পগুলো আনন্দের সঙ্গে আমাদের জানাচ্ছেন। ভাগ্য অনুকূলে না থাকলেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লেবারের সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। আরও ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এমন কোর্সের মাধ্যমে স্ত্রীর গর্ভাবস্থা, লেবার ও ডেলিভারি নিয়ে স্বামীরাও জানার সুযোগ পাচ্ছেন ও স্ত্রীদের প্রতি প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িতে দিতে পারছেন। ফলে পুরো পারিবারিক চিত্রটিই আরও সুন্দর হয়ে উঠছে, আলহামদুলিল্লাহ।

সময় হয়েছে আমাদের বোঝার যে, সন্তান জন্মদানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন। অন্যথায়, ভোগান্তি ক্রয় করতে হবে। অনেকরকম অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা আমরা এড়াতে পারি, যদি নিজেরা জেনে নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ডাক্তার সমাজের বিরুদ্ধে রোগীদের যেসব অভিযোগ আছে সেগুলোও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব এভাবে। যদি আমরা নিজেরাই না জানি তাহলে আমাদের সেবাপ্রদানকারীরা আমাদের সাহায্য করবেন কীভাবে? এই বোধ থেকেই সম্প্রতি এ বিষয়ে আন্তরিক ডাক্তারদের কেউ কেউ মায়েদের ডেলিভারি দিনের জন্য প্রস্তুত করতে উদ্যোগী হয়েছেন বা হচ্ছেন। খুবই আশার কথা এটি।

সেই সঙ্গে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানপ্রসূত দাবীগুলো আমরা ডাক্তারদের কাছে করবই-বা কীভাবে, যদি নিজেরা জানতে সচেষ্ট না হই? পেশেন্ট পার্টির সার্বিক জ্ঞান ও প্রস্তুতির লেভেল যখন আরও উন্নত হবে তখন আমরা সেবাপ্রদানকারীদের থেকেও উন্নত সেবা দাবী করার সুযোগ পাব ইনশাল্লাহ। সম্প্রতি আমাদের দেশে রুটিনমাফিক ব্যবহৃত এপিসিওটমি নিয়ে অনেক মেয়েদের আমি উদ্‌বেগ প্রকাশ করতে দেখছি। এপিসিওটমির অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার নিয়ে দশকের পর দশক লেখালেখি করে উন্নত বিশ্বে এখন এটাকে প্রয়োজন হলে দেওয়া যাবে, অন্যথায় বাতিল প্রাকটিস হিসাবে গণ্য করে। সুতরাং, আমাদের বুঝতে হবে যে আমাদের ভালো অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে তার জন্য নিজেদের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

তাই সব বিষয়ের মতো সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেও সুপরিকল্পিতভাবে জ্ঞান অর্জন করে প্রস্তুতি নেওয়া এখন সময়ের দাবী।

© রাবেয়া রওশীন
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *