ইসলাম

দীন বোঝা সহজ, পালন কঠিন — আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক

আমার এক বন্ধু আছেন। জীবনের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্তই বলা যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি অফিস করেন, ওভারটাইম। তবুও বহুত টেনেটুনে চলতে হয়। সময়মতো বাচ্চার স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে না পারা, বৌ-বাচ্চাদের ছোটখাটো আবদার পূরণ করতে না পারা তার ফি মাসের ঘটনা। অনেক নাসীহাত করেছি, আর্থিক দৈন্যদশা ঘুচানোর সুন্নাহতে বর্ণিত আমলগুলো করা নিয়ে। কিন্তু তেমন পাত্তা দিয়েছেন বলে আমার কখনোই মনে হয়নি। অথচ একদিন ওভারটাইম করতে যে কষ্ট হয় আমার নাসীহাহগুলো পালন করা তার চেয়ে ঢের সহজ। সত্যিই আশ্চর্য মানুষের চরিত্র।

অনেক মানুষকে দেখবেন সালাহ আদায় করতে বললে যেন তার কাছে মনে হয়—এর চেয়ে কষ্টকর আর কিছু এই দুনিয়াতে নেই। এটা না বলে যদি এদেরকে এক মণ ওজনের বোঝা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন—এরা তাতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, কিন্তু নামাজ পড়বে না। শুনেছি, সৌদি আরবে অনেকে সালাতের সময় নাকি গলিঘুপচির মধ্য প্রচণ্ড গরম সহ্য করে পালিয়ে থাকে। অথচ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাসজিদে সালাত আদায় করতে কষ্ট হয়!

আসলেই, দীন বোঝা কঠিন, পালন করা সহজ; আর দুনিয়া বোঝা সহজ, কিন্তু অর্জন করাটা কঠিন। কে না বোঝে, গুলশানে আমার পাঁচতলা একটি বাড়ি থাকলে কতই না ভালো হতো! অথচ গুলশানের বাড়ির একটি টয়লেটের জায়গার দাম উপার্জন করাটাও হয়তো তার পক্ষে সারা জীবনে হয়ত সম্ভব নয়। আর আখিরাত, জান্নাত! এটা অর্জন করার জন্য আপনার পক্ষে একেবারেই সম্ভব। এজন্য আপনার যা আছে তার চেয়ে বাড়তি কিছু দরকার নেই। কোনো সার্টিফিকেট, কোনো মূলধন, কোনো সুযোগ-সুবিধা—কিচ্ছু না। আপনি ল্যাংড়া হন কিংবা লুলা, কানা হন কিংবা খোড়া, শিক্ষিত হন কিংবা মূর্খ—কোনো সমস্যা নেই। আপনি ইচ্ছে করলেই হতে পারেন দশ দুনিয়ার সমান জান্নাতের, চিরস্থায়ী সে বাগানের; সেই বাড়ির, যার একটি ইট স্বর্ণের, আর একটি রুপার, যার সিমেন্ট মিশকের। কিন্তু আমরা ক’জন তা চাই, কিংবা সত্যিকার বিশ্বাস করি যে এমন কিছু সত্যিই আছে—তা এক বিরাট প্রশ্ন।

আখিরাতের প্রশ্ন আসলে আমাদের দৌড় থাকে বটম লাইনের দিকে ‘নামাজ তো ঘরে পড়লেও হয়, মুখ খোলা রাখা তো না জায়েজ নয়, দাড়ি রাখা তো সুন্নত ভাই’ আরো কত কী…। কেবল কোনো একটা করলে চলে। অথচ এই আমরাই আমাদের দুনিয়ার ব্যাপারে এলে আমাদের রেইসটা হয়ে যায় ঊর্ধ্বমুখী। ‘ভাড়া-থাকা ভাই একটা জীবন হলো, যাযাবরের মতো লাগে, নিজের একটা বাহন থাকার কথা ভাই আল্লাহর রাসূলই বলেছেন, হালালভাবে উপার্জন কি নিষেধ ভাই’ সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দেই আরো পেতে, আরো পেতে।

কেন এমন দ্বিমুখী আচরণ আমাদের? এর নিশ্চয়ই একটি কারণ আছে। আর আমার ধারণা, সেই কারণটি হলো, আমরা অধিকাংশ মানুষ আসলে আখিরাতকে বিশ্বাসই করি না। আমরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দোল খেতে থাকি নিরন্তর। একটা হ্যালুসিনেশনের মধ্যে থাকি। মৃত্যুটাকে অবিশ্বাস করি না, করতে পারি না। কারণ, প্রতিনিয়ত এটাকে চাক্ষুস দেখে থাকি। কিন্তু শিগগির যে আমি অন্তত মরছি না এ ব্যাপারে আমরা অবশ্যই নিশ্চিত! আর মৃত্যুর পরে কী হয় তা তো আর দেখি না, তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দুই নৌকায় দুই পা দিয়ে দিব্বি জীবন চালিয়ে চাচ্ছি।

© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *