বই

বই নিয়ে খানিক আদিখ্যেতা না-হয় হলোই — মো. ইয়াসির ইরফান

আমাদের গল্পটা শুরু হোক কোনো এক বৈশাখের কাঠফাটা দুপুরে। এমন তপ্ত গরমে আদৌ কাঠ কভু ফেটেছে কি না জানি না, তবে বুকের ছাতি বুঝি ফেটে যায়! তৃষ্ণায় জিহ্বা বেরিয়ে আসতে চায়, ঠোঁটের উপরিভাগ চাটতে থাকে নোনা যা পাওয়া যায় তা-ই। অথচ পার্কের বেঞ্চিতে বসা নিমগ্ন কিশোরের কোনো বিকার নেই। মাথা নীচু করে বইয়ে ডুবে আছে সে। পাশে আছে বইয়ে ঠাসা আরো একটি ব্যাগ।

ঘর পালানো কিশোর সে।

কি লাগবে? বই।

কি কিনবি? বই।

কিছু খাবি? না। তা দিয়ে বরং বই কিনি!

জামাগুলো পুরনো হয়ে গেছে। নতুন জামা নিবি না?

না। বই নেবো।

বইয়ে বইয়ে ভরিয়ে ফেলেছে তার তাক, খাট, র‍্যাক, টেবিল, ওয়েরড্রোব সব। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিলে পুরোটা সময় বই পড়ে কাটায়। তা দেখে রেগে বাবা বলেছেন- বিদ্যাসাগর হবে? মহাপন্ডিত হবে? বইয়ের আড়ৎ দেবে নাকি? আর বই কেনার কথা বলেছো তো ঠা ঠা ঠা করে গুলি করে মারবো। যত্তসব!

তা শুনে এক ব্যাগ বই নিয়ে ঘর পালিয়ে পার্কে বসে আছে ছোকরা। পেছনে এসে দাঁড়ান বাবা। খোকা, কি করছিস!

আচমকা মাথা তুলে বাবাকে দেখে সে। যেনো কিছুই হয়নি, আস্তে করে জবাব দেয়- বই পড়ছিলাম বাবা।

বাড়ি চল…

বই ব্যাগে ঢুকিয়ে, ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে বাবার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে কিশোর। বই পড়ুয়া কিশোর। বইপ্রেমী কিশোর। বইয়ের জন্য ঘর পালানো কিশোর।

মানুষ কত কারণে ঘর ছাড়ে। প্রেমের জন্য, বাঁচার জন্য, টাকার জন্য, জীবিকার জন্য, বউয়ের জন্য, কবিতার জন্য কিংবা ভালোবাসার জন্য। সে ভালোবাসা হতে পারে নারীর, বা কবিতার, বা লেখালেখির, বা অন্য যে কোনো কিছু। কিন্তু বইয়ের জন্য কেউ কি কভু ঘর ছাড়ে?

বইভর্তি আলমারি। অনেক অনেক বই। আর একটা বারান্দা। একটা চেয়ার। একটা টেবিল।

অনেকের শৈশবের লালায়িত স্বপ্ন। বহু আরাধ্য স্বপ্ন। সময়ের সঙ্গে বয়সের আঁচড়ে মিলিয়ে যায় সব। বই থাকে হয়তো। অনেকগুলো নয়, সামান্য ক’টা। অথবা একটাও নয়। বহু ক্রোশ দূরত্বে থাকে বই। দেখা আর হয় না, পড়া আর হয় না। যেনো জন্মের আড়ি বইয়ের সঙ্গে।

আচমকা এই সময়ে বই নিয়ে এমনতর আলোচনা, কিঞ্চিৎ আদিখ্যেতা মনে হতেই পারে। ‘বই’ ব্যাপারটাই অনেকের কাছে আদিখ্যেতা। দুনিয়াজোড়া কত-শত আদিখ্যেতা, আজ হলোই-বা না-হয় এই বই নিয়ে খানিক আদিখ্যেতা!

আজ বুক শেলফে সাজানো বইগুলোকে ঝাড়পোঁছ করবো বলে নামাই, পরম যত্নে ধুলো মুছে দিই, পোকাদের বাসস্থান গুড়িয়ে দিই, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিষ্কার করি যত ময়লা। আজকের দিনটা হোক না এমন কোনো দিন!

বই পরিষ্কারের মতোই বই নিয়েও হোক খানিক আলোচনা। মন্দ কি? তাতে চিন্তাগুলো পরিষ্কার হয়, আত্মায় খানিক ঝাড়পোঁছ হয়, ফলে ধুলোর আস্তরণে আটকে থাকা ভাবনার দোর কিছুটা খুলে যেতেও তো পারে!

বই পড়ে লাভ কী? শুধু শুধু সময় অপচয়।

বই কিনে লাভ কী? শুধু শুধু অর্থের অপচয়।

বই পড়লে অবশ্য ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ ভাব নেয়া যায়। বেশ পন্ডিত পন্ডিত মনে হয় নিজেকে। বই পড়ুয়াদেরও দূর থেকে তাই মনে হয়। সবকিছুতে পন্ডিতি, হামবড়া।

সবাই যদি বই পড়ে, পন্ডিত হয়, বুদ্ধিজীবি মনে করে নিজেকে, তাহলে তো কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। আসলেই কী?

একদম না।

বই আপনাকে দেবে সীমাহীন উদারতা। বইয়ের সংস্পর্শে আপনি হবেন মহৎ, উদার, বিরাট। জগতের ছোট ছোট ব্যাপারগুলো আপনাকে স্পর্শ করবে না। আপনার বড় মন সেসবে গা করতে চাইবে না। আপনার বিশাল সত্ত্বা আপনাকে সংকীর্ণ হতে দেবে না কিছুতেই। পাবলিক বাসে সিট পাওয়ার জন্য নির্লজ্জ ধাক্কাধাক্কি, চলতে ফিরতে হুটহাট গালাগালি, একে-তাকে ল্যাঙ মেরে এগিয়ে যাওয়া, উপরে উঠতে কাউকে তেল মর্দন আর কারো ঘাড় ভাঙা… আপনি এসবে শামিল হতে পারবেন না। যারা এসব করছে তাদেরকেও ক্ষুদ্রজ্ঞান করবেন না, যেনো মনে হবে- আহারে! এসবের নিস্ফল পরিণতি ওরা বুঝতে পারছে না!

অবোধ শিশুর চাঁদের সঙ্গে হাঁটা-চলা দেখে যেমন হেসে উঠেন, যেমন ভাবেন- বাবু বড় হলে বুঝবে। ঠিক তেমনি এই ক্ষেত্রেও আপনি বলবেন- বুঝলে নিশ্চয় এমনটা করত না! কেউ আপনাকে গালি দিলে পালটা গালি দিতে পারবেন না, কেউ আপনাকে তুচ্ছ করলে পালটা প্রতিক্রিয়ায় তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে পারবেন না। বই আপনাকে অনুদার হতে দেবে না, অমহৎ হতে দেবে না।

বইয়ের সঙ্গে আপনি হয়ে উঠবেন চূড়ান্ত রুচিশীল, সুবোধ, সুকোমল একজন।

মোদ্দা কথা, বই পড়লে আপনি ঠকবেন না।

সময়ের অপচয়? বরং সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার বোধকরি এর চেয়ে আর কিছুতে হয় না।

আর রইলো অর্থের অপচয়। পড়ার জন্য অর্থের দরকার পড়ে না। দরকার কেবল পাঠক মন। জ্ঞানের সুতীব্র আকাঙ্খা, জানার ভীষণ ইচ্ছা। তবে বই সংগ্রহে বা জমা করতে অর্থের প্রয়োজন হয়।

অর্থের বিনিময়ে আমরা কী কী করি? ভালো খাই। ভালো পরি। ভালো থাকি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। আর্থিক সাচ্ছন্দ্য আমাদের শরীরকে কষ্ট পেতে দেয় না মোটেই। সিএনজি নাও, উবার ডাকো, পয়সা ঢালো, শান্তি কেনো। পয়সা দিয়ে আমরা সুখ কিনি। অথবা কিনতে চাই।

কাপড় পুরনো হয়। ঘর যেমন আছে তেমন, নতুনত্ব নেই কোনো। খাবার তো গেলার সাথে সাথেই শেষ। অথচ অর্থ দিয়ে বই কিনে দেখুন, তা কখনোই পুরনো হবে না।

মানুষ অর্থ দিয়ে নানান রঙের জিনিস কিনে, আপনি জ্ঞান কিনুন। নিশ্চিত থাকুন ঠকবেন না।

হ্যাঁ, বইও পুরনো হয়। তবে বাহ্যিক অবয়বে। বই আপনাকে যে জ্ঞান দেয়, তা কখনোই পুরনো হওয়ার নয়। বরং জ্ঞান- জ্ঞান টানে। এক বই, টেনে আনে আরেক বইকে। একটুকরো জানা- জাগিয়ে তুলে অনেকখানি জানার ইচ্ছা।

আত্মার তৃপ্তিতে অর্থের এমন সুন্দর ব্যবহার আর দ্বিতীয়টি আছে কি না আমার জানা নেই।

বই আপনাকে দেয় বিস্তৃত এক জগৎ। যে জগতে কেবল আপনারই বিচরণ। আপনিই রাজা সেখানে, আপনিই একমাত্র। বই স্বপ্ন দেখায়, কল্পনা জাগায়, ভাবনা যোগায়। অবারিত কল্পনার ফল্গুধারায় আনায়াসে ভাসতে পারেন আপনি। এই পৃথিবীতে আকাশের কোনো সীমারেখা নেই, সাগরেরও নেই কোনো সীমারেখা, এবং সীমারেখা নেই কল্পনারও।

পৃথিবীর একজন হয়ে যদি সীমাহীন কোনো কিছুর মালিক হতে চান- তাহলে আপনাকে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ শিখতেই হবে। আর তা আপনাকে শেখাতে পারে কেবলমাত্র বই-ই।

ইচ্ছে মতো বই পড়ুন। আগ্রহ নিয়ে বই পড়ুন। যেমন বই ভালো লাগে তেমন বই পড়ুন। বই পড়াটা গুরুত্বপূর্ণ, কী পড়ছেন তা নয়। ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, ক্রিকেট, ফুটবল, গল্প, উপন্যাস, কবিতা… যা ভালো লাগে তা পড়ুন। এবং অবশ্যই আগ্রহ নিয়ে পড়ুন। কাউকে দেখাতে নয়, কাউকে বোঝাতে নয়, ভাব নিতে নয়, পন্ডিত সাজতে নয়, বই পড়ুন বই-কে ভালোবেসে। আন্তরিক আগ্রহে।

ফেসবুক, ব্লগেও তো প্রচুর পড়ি? আলাদা করে বই পড়ার কী দরকার?

উঁহু, পত্রিকা পড়া আর বই পড়া এক নয়।

ম্যাক্সিম গোর্কীর একটা উক্তি পড়ে, বা ‘মা’ উপন্যাস নিয়ে দু’চার লাইন পড়ে- ‘মা’ উপন্যাস কী আদর্শ লালন করছে, কী স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছে, কীভাবে বোঝাতে চেয়েছে, পাভেল-খখল কিংবা মা-কে ঠিকঠাক বুঝতে পারবেন না কোনোদিন। শরীফ আবু হায়াত অপু’র এক-দুইটি স্ট্যাটাস বা ফেসবুকে তাঁকে ফলো করে আপনি কখনোই ‘বাক্সের বাইরে’ বা ‘তত্ত্ব ছেড়ে জীবনে’ বই দুটোর আবেদন উপলব্ধি করতে পারবেন না। দুই মলাটের ভেতরকার বক্তব্য, গল্প বা আদর্শ কে বোঝার জন্য আপনাকে বই পড়তে হবে।

‘হাজারী গানের মাথা’ শুনেছেন কখনো?

অনেকগুলো গান কেবল এক লাইন বা বড়জোর দু’লাইন করে গেয়ে যান গায়ক। তাতে পুরো একটি গানের স্বাদ মেলে কি? শ্রোতার কানে কোনো রেখাপাত করে কী সেই এক কলি, দুই কলি?

বইয়ের আনন্দ আর কিছুতে নেই। পাঠক হওয়ার মতো মজা আর কিছুতে নেই। পাঠক হোন। বই পড়ুন।

প্রেমিকার জন্য ঘর ছেড়ে ঠকতে পারেন। বউয়ের জন্য ঘর ছেড়েও হয়তো কাঙ্খিত সুখ পায়রা পাবেন না। জীবিকার জন্য ঘর ছেড়ে লাভ নাও হতে পারে। জীবনের যে অপূর্ণ লক্ষ্য পূর্ণ করবেন বলে ঘর ছেড়েছেন তা বুমেরাং হওয়াও বিচিত্র নয়।

কিন্তু বইয়ের জন্য ঘর যদি ছাড়েন- তাতে বিফল হওয়ার বদলে সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।

তার মানে এই নয় যে, আপনাকে ঘর-সমাজ ছেড়ে দূর নির্জনে বইয়ের সঙ্গে সংসার পাততে বলছি। বলতে চাইছি- অন্য যে কোনো কিছুতে ঠকলেও বইকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন না। বই আপনাকে দেবে দু’হাত ভরে।

দু’হাত মেলে তা নেবেন কি নেবেন না সে সিদ্ধান্ত আপনার!

© মো. ইয়াসির ইরফান
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *