চিন্তালাপ

বিয়ে, সম্পর্ক ও যৌনতা — জাহিদ হাসান

গতকাল এক ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বিয়ে-সম্পর্ক—এসব নিয়ে। কথা হচ্ছিল শারীরিক আকর্ষণ, ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়ে। ভালোবাসাকে একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। সে সংজ্ঞায়নে নিজের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা ফুটে ওঠে।

ভালোবাসার ধারণাটা আসলে বিমূর্ত। সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে ভালোবাসাকে সহজে ম্যাটেরিয়ালাইজ করা যায় না। যেসব বিখ্যাত ইমাম বিয়ে করেননি—তাদের একজন হলেন ইমাম নববি রহি.। একবার তিনি তাঁর সুন্নাহ অনুসরণের কথা বলতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন—একমাত্র বিয়ের সুন্নাহই আমার পালন করা হয়নি, কারণ আমি জ্ঞানের প্রতি এত বেশি ভালোবাসা অনুভব করি যে, আমার ভয় হয়েছে, জ্ঞানান্বেষণে মশগুল থাকার কারণে হয়তো আমার স্ত্রীর হক আমি  সঠিকভাবে আদায় করতে পারব না। ইমাম নববির এই উদ্বৃতি কতটুকু সত্য জানি না, তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলাই যায়—ভালোবাসার ব্যাপারটা শুধুমাত্র নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাজ করে না; বরং ভালোবাসার পরিসর আমাদের চিন্তার থেকেও অনেক বড়।

যারা যৌনচাহিদা কিম্বা শারীরিক আকর্ষণকে ভালোবাসা জ্ঞান করে, তারা একটা বিষয়ে বড় বেশি ভুল করে। বিমূর্ত ভালোবাসাকে যখন শারীরিক কিম্বা বস্তুগত অবয়বে সীমিত করে ফেলা হয়,  ভালোবাসা তখন তার অসীমতা হারিয়ে অতি তুচ্ছ হয়ে পড়ে। আমরা আজ যার দৈহিক লাবণ্য-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই, সেই মানুষটির শরীরে একসময় বয়সের ছাপ পড়ে, চামড়া কুচকে আসে, বার্ধক্যের বলিরেখা পড়ে। তখন আমরা তার প্রতি সেই ভালোবাসা হারিয়ে ফেলি, যা আগে অনুভব করতাম। অথচ শরীর খুব কমই একজন মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে। মানুষটির ব্যক্তিত্ব, সততা, রুচিশীলতা, দয়াপরবশতা—ইত্যাদি বিমূর্ত ব্যাপারগুলো আমাদের অন্তরে যে সত্যিকারের প্রশান্তি আর মুগ্ধতার বিকাশসাধন করে, তাতেই প্রকৃত ভালোবাসার বীজ নিহিত থাকে।

আমরা যাকে ভালোবাসব, তার সত্যিকারের কল্যাণকামী হব। তার ছোটখাটো মানবিক ত্রুটিগুলো আমরা ক্ষমা করতে শিখব, তার ভালো গুণগুলো থেকেই আমরা তাকে পরিমাপ করতে জানব। এই ভালোবাসা যেমন থাকবে যৌবনে, তেমনি বার্ধক্যে। আর এই পরম ভালোবাসা দুনিয়াতে মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে না; বরং যাকে বা যাদের আমরা সত্যিকারের ভালোবাসি, আমরা মন প্রাণ দিয়ে চাই—যাতে জান্নাতেও আমরা তাদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারি।

আমরা আজকাল ভালোবাসা শিখি সিনেমায়, টিভি সিরিয়ালে, কমার্সিয়াল বিজ্ঞাপনে। যেখানে আমাদের ভালোবেসে কাছে আসার গল্প শোনানো হয়, কিন্তু গল্পের আড়ালের সত্যিকারের জীবনগুলোর প্রকৃত রূপ আমরা দেখি না। যাদের থেকে আমরা ভালোবাসার বস্তুবাদী ধারণা শিখি,  তাদের জীবনে বিবাহবিচ্ছেদ দেখি অহরহ। ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হয়। ভালোবেসে পাওয়ার কিছু নেই, আছে কেবল দেওয়ার। যে ভালোবাসা ধৈর্য ধরতে কিংবা ক্ষমা করতে শেখায় না, তাকে ভালোবাসা কীভাবে বলি? অথচ সম্পর্কে ইগোর চর্চা, আত্মকেন্দ্রিকতা, শুধু প্রাপ্তির বাসনা আমাদের ভালোবাসাগুলোকে মেরে ফেলে। ভালোবাসার বস্তুকরণের কারণে আমাদের বিয়েগুলো টেকে না। এমনকি সন্তান জন্মের পরেও কোনো কোনো দম্পতি ব্যক্তিস্বার্থের তাড়নায় নিজেদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটায়, যার চরমতম ভুক্তভোগী হয় তাদের সন্তান। বিচ্ছেদ হওয়া বাবা-মায়ের সন্তানরা এক ধরণের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নিয়ে বড় হয়, এই গ্লানি তাদের বয়ে নিয়ে যেতে হয় সারাটা জীবন।

এবার যৌনতা নিয়ে কিছু কথা বলি। যৌনতা আমাদের স্বাভাবিক শারীরিক প্রবৃত্তি। যৌনতা যদিও স্বয়ং ভালোবাসা নয়; কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আল্লাহ আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যৌনতার প্রকাশ কিংবা যৌন আচরণের ক্ষেত্রে সীমানা টেনে দিয়েছেন। বৈধভাবে যৌন চাহিদা মেটানো যায় বিয়ের মাধ্যমে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সমাজ বিয়েকে অনেক কঠিন বানিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ কিংবা তরুণী তাদের সঠিক বয়সে বিয়ে করতে পারে না। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার কিংবা আরও নানাবিধ সামাজিক চাপে যথাসময়ে বিয়েটা করা হয়ে ওঠে না। যার ফলশ্রুতিতে আমরা বিবাহযোগ্য প্রায় সবাই বয়ে চলেছি এক অস্বাভাবিক আর উদ্ভ্রান্ত যৌনজীবন।

আর বর্তমান বৈশ্বিক ভোগবাদী-বস্তুবাদী সভ্যতায় আমাদের অতৃপ্ত যৌন চাহিদাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে ট্রিলিয়ন ডলারের পর্ন ইন্ডাস্ট্রি। আমরা খুব সচেতনভাবেই এসবের ভোক্তা হচ্ছি, অশ্লীলতায় গা ভাসাচ্ছি, নিজেদের নৈতিকতা এবং শরীরের ক্ষতি করছি; এতে লাভবান হচ্ছে ভোগবাদ আর পুঁজিবাদের ধারক বাহকরা।

যৌন চাহিদা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, আমাদের খাওয়া কিংবা ঘুমের চাহিদার মতোই। মানুষ যেমন একটা সময়ের পর আর অনিদ্র, অভুক্ত থাকতে পারে না, যৌনতার ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই। ঘুমের চাহিদা না মিটিয়ে রাতের পর রাত গেছে পড়াশোনা করলে, তবে সম্ভাবনা থাকে পরীক্ষার হলে ঘুমিয়ে পড়ার। তেমনি স্বাভাবিক উপায়ে যৌন চাহিদা মেটাতে না পারলে মানুষ অস্বাভাবিক উপায় বেছে নেয়। স্বাভাবিক রুজিরোজগারের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ চুরি ডাকাতির পথ বেছে নেয়।

সঠিক সময়ে বিয়ের সুযোগ না থাকায় আমাদের যুবসমাজ পর্ন আসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রেমের নাটক করে বিয়ের পূর্বেই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে ভন্ড প্রেমিকরা অসংখ্য তরুণীর জীবন লিটারেলি ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর কিছু কিছু মানুষ উন্মাদ হয়ে ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটাচ্ছে। অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে না পেরে সমাজের কিছু মানুষ যেমন ডাকাতির পথ বেছে নেয়, ধর্ষকদের ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই। সমাজে স্বাভাবিক সময়ে যৌনচর্চা এবং বৈধ বিয়ের সুযোগকে অবারিত করা গেলে যৌন-আসক্তি ঘটিত অসংখ্য অনাচার থেকে আমাদের সমাজ রক্ষা পাবে।

একজন পতিতা পেটের দায়ে কিংবা অপহরণের শিকার হয়ে পতিতাবৃত্তিকে বেছে নেয়। সমাজের কিছু মানুষ তাদের কাছে গিয়ে যৌন চাহিদা মেটায়; কিন্তু সেখানে শুধু লালসাই থাকে, ভালোবাসা থাকে না। যৌন চাহিদা মেটানোর পর সে লোকটিই পতিতা নারীটাকে ঘৃণাভরে অশ্লীল বাক্যব্যয়ে গালি দেয়। সেসব গালি শুনতে শুনতে পতিতা নারীর হৃদয় প্রতিনিয়ত দুমড়ে মুছড়ে যায়। তবু আর্থিক চাহিদার কাছে তার হাত-পা বাঁধা থাকে। তাই যৌনতা কিংবা শারীরিক আকর্ষণকেই যারা ভালোবাসা মনে করেন, তারা এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন।

মেয়েদের উচিত যত্রতত্র নিজেদের আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন না করা; কারণ এতে মানুষ ঠিকই আকর্ষিত হবে, কিন্তু সেখানে ভালোবাসা থাকবে না, থাকবে লালসা। মেয়েদের অন্তত নিজেদের ব্যাপারে এই সম্মানবোধটুকু থাকা উচিত। আর ছেলেদের উচিত সত্যিকারের ভালোবাসা কী জিনিস তা শেখা, নারীদের সম্মান করতে শেখা। শুধুমাত্র যৌনতার তাড়নায় যে বিয়ে, সে বিয়ে বেশিদিন টিকে না। আমাদের অন্তরে সত্যিকারের ভালোবাসা জাগানো উচিত, এতে করে আমাদের যৌনজীবন যেমন অসাধারণ হবে, তেমনি আমরা আমাদের সম্পর্কগুলোকেও বয়ে নিতে পারব আমৃত্যু—এমনকি জান্নাত পর্যন্ত।

© জাহিদ হাসান
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *