চিন্তালাপ

গিরিজ সভ্যতা! — আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক

ছেলে-মেয়েদের সাথে মাঝেমধ্যে আমাদের ছোট বেলার নানা বিষয় নিয়ে গল্প করি। এই মরিচ-পান্তা কিংবা বড়জোর ডিম-পান্তা দিয়ে টিফিনের গল্প; হাটু অব্দি কাদায় দেবে যাওয়া রাস্তায় দেড়-দু কিলো হেটে স্কুলে যাওয়ার গল্প। তালপাতার খাতা, বাঁশের কঞ্চির কলম, আর কয়লা দিয়ে বানানো কালিতে স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ লেখার গল্প। শীতের দিনের দাড়িয়াবান্দা, গ্রীস্মের বিকেলে বৃষ্টিকাদায় একাকার হওয়া মাঠে গোল্লাছুট খেলার গল্প; দশ পয়সা দিয়ে ঝুরিভাজা কিনে খাওয়ার গল্প—আরও কত কী!


ওদেরকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোরা তোদের ছেলে-মেয়েদের কাছে কী নিয়ে গল্প করবি, তোদের জীবনে গর্ব করে গল্প করার মতো কী অভিজ্ঞতা আছে? ওরা আমাদের গল্পগুলোর সামনে তেমন কিছু খুঁজে পায় না বলার মতো। ওদের জন্য সত্যিই তখন মায়া হয়। একেক দিন একেক বাহারি আইটেমের টিফিন, বাসা থেকে গাড়িতে পা দিয়ে উঠে স্কুলে যাওয়া, এসি রুমের মধ্যে আরামে ক্লাস, আর বাসার ড্রইং রুম কিংবা পাশের সরু গলিতে খেলাধুলা নিয়ে কী গল্পই বা ওরা করবে তাই ভেবে পাই না। লুকিয়ে আব্বু-আম্মুর ফোন নিয়ে চিপায় গিয়ে ইউটিউব দেখার গল্প কি কেউ হা করে শুনবে?


আমাদের পুরনো দিনগুলো কষ্টের হলেও দুঃখের ছিল না; আভিজাত্য না থাকলেও গর্ব করার মতো অনেক কিছু ছিল। অন্তর্জাল আসার আগে মানুষদের মাঝে অশ্লীলতার ব্যাপারে বেশ একটা রক্ষণশীল ব্যাপার ছিলো। আমাদের ছোটবেলায় বিটিভিতে মাসে এক শুক্রবার একটা সিনেমা দেখাতো। এরশাদ সাহেবের শেষের দিকে যখন শুক্রবার দিন মিছিল মিটিং পরিমাণ বেড়ে গেলো উনি প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দিলেন লোকদেরকে শুক্রবার বিকেলে ঘরে রাখার জন্য। গড়পরতা সাধারণ মানুষদের এটাই ছিল সহনীয় মাত্রার অশ্লীল বিনোদন। সিনেমায় দেখা নায়ক নায়িকাদের সামান্য ঘনিষ্টতা নিয়েও নানারকম গল্প শুনতাম। এতটুকু বিষয় নিয়েও মানুষের মাঝে বেশ একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ছিল। সেই লজ্জা কাটাতে তারা নানা ব্যাখ্যাও বানিয়ে নিতো নিজেদের মতো করে। সাধারণ মানুষ এতটুকু ঘনিষ্টতাকেও বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে পারত না; মনে করত ওগুলো সব ক্যামেরার কারসাজি। নায়ক-নায়িকারা দূরে দূরেই থাকে, ক্যামেরা কৌশল করে কাছে এনে দেখায়। মানুষের মাঝে রক্ষণশিলতা যখন এত প্রবল ছিল, প্রকাশ্য অশ্লীলতা যখন এতই বিরল ছিল আমি সে সময়ের একটি সত্যি ঘটনা আজ আপনাদের শোনাবো।


মি. চৌধুরি। আমার প্রতিবেশি ছিলেন কিছু দিন। লোকটা শিক্ষিত না হলেও বেশ চালাক-চতুর। পার্শ্ববর্তী একটি দেশে অনেক বছর থাকার কারণে লেখালেখি জগতের লোকদের ব্যাপারে তার মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ আছে। যখন সে জেনেছে আমার বিচরণ এই জগতে তখন সময় পেলেই গল্প করতে চাইত।


কয়েকদিন গল্প করেই আমি বুঝেছিলাম যে সে আমার জন্য এক কালের সাক্ষী হয়ে আবির্ভুত হয়েছে। আজ তার নিজ জবানিতে শোনা তারই নিজ জীবনের একটি গল্প বর্ণনা করব আপনাদের। বর্ণনাসূত্রে এখানে কোনো বিচ্ছেদ নেই, নেই কোনো অতিরঞ্জন। কেবল আমি আমার ভাষায় বর্ণনা করছি।


তার বয়স তখন আটাশ ত্রিশ হবে। যুবক বয়স। এমনিতেই তিনি সুঠামদেহি চওড়া হাড়ের পেটানো শরিরের মানুষ। গিয়েছেন আমাদের দেশের সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক ব্রোথেলে।


‘সরকারি তত্ত্বাবধান’ এর ব্যাপারটা নিয়ে আপনি বর্তমান সরকারের উপর চটে যাবেন না প্লিজ। এটা নির্দিষ্ট কোনো সরকারের বিষয় নয়; এটা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। এখানে সব সরকারের নীতি একই ছিল। এটা জেনে আপনি মোটেই কষ্ট পাবেন না প্লিজ যে, আপনার জাতীয় মসজিদের ইমামের বেতন কিংবা মসজিদের কার্পেট, আর আযানের মাইকেও এই ব্রোথেল থেকে আহরিত ট্যাক্সের অংশ আছে—সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক।


মিস্টার চৌধুরির জীবনে এসব জায়গাতে যাওয়া, কিংবা এসব জায়গার বাইরেও এমন কুকর্মের ফিরিস্তি বেশ লম্বা। তার কাছে এ ধরনের পরিবেশ মোটেই নতুন নয়; তেমন ইতস্ততও বোধ করেন না তিনি। আসা-যাওয়া করতে করতে এসব ইতস্ততবোধ কাটিয়ে তিনি এখন যথেষ্ট স্মার্ট।


উনি এরিয়ার মধ্যে প্রবেশের পর হাটতে আর দেখতে লাগলেন। একেক মেয়ে এসে একেক রকম অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল তার সামনে এসে। নিজেদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা প্রতিযোগিতার ভাব। কে তার কাছে আগে বিক্রি হতে পারবে তা নিয়ে। চৌধুরী সতর্ক চোখে এর দিকে ওর দিকে তাকান; কারও চোখের চোরা চাহনি, কারও ঠোটের বাঁকা হাসি; কারও চেহারায় রংচটা মেকাপের ঝাঁঝ, কারও গায়ে সস্তা পারফিউমের ঝাঁঝালো ঘ্রান—যার যা কিছু আছে তার সব নিয়েই তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিজেকে বিক্রির যুদ্ধে, নিজের ইজ্জত বিক্রির যুদ্ধে। লাখো নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে নারীরা স্বেচ্ছায় ইজ্জত বিক্রির যুদ্ধে অবতীর্ণ। আহা! স্বাধীনতা তুমি… অনেক দেখেশুনে একটি মেয়ে তার চোখে ধরে; চোখে ধরে বলতে বুঝিয়েছি এখানে তো মনে ধরার নিয়ম নেই! কিন্তু এক রাতের জন্য মেয়েটি তার দাম হেঁকে বসে পাঁচশ টাকা। প্রায় ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর আগের কথা। পাঁচশ টাকার অনেক দাম। এর কাছে একটি মেয়ের ইজ্জত তেমন কিছুই না। দরদাম করে কমানোর চেষ্টা করে লাভ হয়নি। শেষমেষ এক রাতের জন্য ঐ দামেই চৌধুরি কিনে নেন তাকে।

পাঁচশ টাকা তো কম নয়। উসুল করা চাই সূদে আসলে। যত বেশি খুবলে খাওয়া যাবে, তত উসুল। একবার এই পেশার এক নারীর সাক্ষাতকার পড়েছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, খদ্দেররা তাদেরকে কেমন আদর করেন, কিংবা ভালোবাসেন কি না। তিনি বলেছিলেন, ভাড়ার গাড়ির প্রতি মানুষের আর কতই বা যত্ন থাকেজ! কত দ্রুত চালানো যায়, কত দ্রুত টাকা উসুল করা যায় সেটাই তার কাছে মুখ্য। তাতে গাড়ি ভাংলো না চুরলো তাতে তার কী আসে যায়! তিনি নিজেকে সেই ভাড়ার গাড়ির সাথে তুলনা করেছিলেন বোঝানোর জন্য। তাদেরকে যারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নেন তাদের লক্ষ্য থাকে এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কত বেশি উসুল করা যায় তার দিকে। উসুলের জন্য যদি শরীরের স্বাভাবিক শক্তিতে না কুলায় কেউ কেউ কৃত্রিম উত্তেজক ঔষধ খেয়ে নেন—উসুলের নেশায়।


চৌধুরির অবশ্য এসব নাকি কিছুই দরকার হয় না। এমনিতেই এক শ’তে এক শ’। প্রথম রাতের মধ্যেই দু’বার গমনের পর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মি. চৌধুরী। এই সময় মেয়েটির মধ্যে একটু আনমনা ভাব দেখতে পেলেন। এরপর বিশেষ প্রয়োজনের কথা বলে বাইরে যায় মেয়েটি। চৌধুরী এনার্জি রিগেইন করার জন্য একটা ন্যাপ নিয়ে আবার ফ্রেশ। এখন তার আবার নেশা চড়েছে—পয়সা উসুলের নেশা। কিন্তু মেয়েটি আর ফেরার নাম করছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি তার খোঁজে বাইরে বেরিয়েও কোনো কুল কিনারা করতে পারলেন না—তার কোনো খোঁজ নেই।


অগত্যা তিনি গিয়ে এই বিশেষ স্থানের শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকদেরকে বিষয়টি জানালো। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তারা মেয়েটিকে খুঁজে বের করে ফেলল। খুঁজে এনে তারা তাকে তার প্রতারণার জন্য বকাবাদ্য করতে লাগল যথারীতি। এমন ‘পবিত্র’ জায়গায়, ধোঁকা-প্রতারনা মোটেই যে গ্রহণযোগ্য নয় তা তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো। অবশেষে মেয়েটি জানালো যে তার ‘প্রেমিক’ এসেছে তার কাছে; তাই তাকে এখন সময় দিতে হবে। এখন আর চৌধুরির কাছে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়।


এদিকে পাঁচশ টাকায় চৌধুরীর সাথে যে চুক্তি সে করেছিল সেখানে নাকি কমপক্ষে পাঁচবারের একটা মৌখিক কথাও ছিলো। যেহেতু এখন পর্যন্ত মাত্র দু’বার সম্পন্ন হয়েছে, তাই মেয়েটির কাছে এখনও তার তিন’শ টাকা প্রাপ্য।


আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে তিন’শ টাকা উদ্ধার করে দেয় এবং এর বিনিময়ে তারা কোনো বখশিসও নেয়নি। এ ঘটনা শুনে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনির লোকদের সততার ব্যাপারে আমাকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হয়েছে। শুধু যে কথাটা বারবার মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধেছিল তা হচ্ছে- গোটা দেশটা পতিতালয় হয়ে গেলেই হয়ত দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি তুলনামলক ভালো থাকত। হয়ত পশ্চিমা দেশগুলোতে একারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলনামুলক ভালো।

এখন মিস্টার চৌধুরি আবার নতুন খদ্দের। তার পেছনে এবার দালাল লেগে যায়। তাদের নেটওয়ার্কে থাকা মেয়েদের বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট বর্ণনা করে তাকে প্রলুব্ধ করে। শেষমেষ চৌধুরির মন সব কিছু ছাপিয়ে অল্প বয়সি মেয়ের দিকেই প্রলুব্ধ হয়। কচি হওয়ার সুবাদে ওদের দাম নাকি একটু বেশি। তাই অর্ধ রাতের জন্যও তাকে পাঁচশ টাকা দিতে হবে।


চৌধুরির বর্ণনামতে সেই মেয়েটির বয়স বড়জোর বারো তেরো হবে। কিন্তু গায়ে পায়ে কেমন যেন বাড়ন্ত সাস্থ্যের ছাপ। চৌধুরী তার কাছে তার বয়স জানতে চাইলে সাথে সাথেই বলে উঠল- ‘বারো’। হয়তো সে অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছে, বয়স কম হওয়াটা তার ডিমান্ড বৃদ্ধির সাথে সম্পৃক্ত। এরপর জানা গেল তার এই বাড়ন্ত স্বাস্থ্যের গোপন রহস্য! কুরবানির আগে যেমন গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া চলে- তেমনি মেয়েটিকে এখানে আনার পর তার সর্দারনিও তার ওপর মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। বিশেষ এক ধরণের ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য; যেন খদ্দেররা তাকে পছন্দ করে।

মি. চৌধুরি। দু-পেয়ে প্রাণি। এতসব কিছু তার কাছে কেবলই তথ্য, যা কেবল কানে শুনে মস্তিস্কের সেলে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। এগুলো প্রসেস করে কোনো মানবীয় সিদ্ধান্তে আসার কোনো প্রয়োজন তিনি বোধ করেন না। কেবল টাকা উসুলের চিন্তাই তার মাথায় ঘোরে।


মেয়েটি বাচ্চা হলেও চৌধুরী তো মোটেই বাচ্চা নন। উপগত হওয়ার সময় বেশ আশ্চর্য হয়ে যান তিনি। অস্বাভাবিক পিচ্ছিল! তিনি যেহেতু বিবাহিত এবং যুগপৎ চরিত্রহীন তাই এ কর্ম তো তার কাছে পুরনো কিছু নয়। এর স্বাভাবিকতা অস্বাভাবিকতা, গতিপ্রকৃতি সবই তার নখদর্পনে। স্বাভাবিকভাবে এত বেশি পিচ্ছিল তো হওয়ার কথা না। এতটুকুন মেয়ের এমন একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে নিতে যে অস্বস্তি বোধ করার কথা তা হয়ত নিষ্পেষিত হতে হতে চলে গিয়েছে। কিন্তু এত পিচ্ছিলতা তো কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে হওয়া সম্ভব নয়!


কর্ম শেষ করে প্রাণিটি এখন নিস্তেজ। একটু বিশ্রাম নিয়ে এবার কিছু কথাবার্তার পালা। মেয়েটিকে এমন অস্বাভাবিক পিচ্ছিলতার রহস্য জিজ্ঞেষ করলো। মেয়েটি প্রথমে এটাকে অল্প বয়সি মেয়েদের বৈশিষ্ট্য বলে চালিয়ে দিতে চাইল। হয়ত খদ্দের হিসেবে চৌধুরিকে স্বচ্ছল মনে হওয়ায় তাকে বারবার পাওয়ার আগ্রহ। তাকে আকৃষ্ট করার এক পাপেভরা নিষ্পাপ স্বীকারোক্তি। কিন্তু চৌধুরি নিশ্চিত ছিলেন যে ব্যাপারটা অন্য কিছু। বারবার চাপাচাপি করতে করতে মেয়েটি একসময় তার নিরাপত্তা ভিক্ষা চাইলো। সম্পূর্ণ গোপন রাখার শর্তে সে জানালো যে, এখানকার সর্দারনিরা ছোট মেয়েদের গোপন অঙ্গের ভেতরটা পিচ্ছিল করার জন্য গিরিজ দিয়ে দেয়। হ্যাঁ, যথারীতি মোটর পার্টসের বিয়ারিং এ ব্যবহৃত গিরিজ। যেন পথটা অতিমাত্রায় পিচ্ছিল হয় এবং খদ্দের অধিক সুখ উপভোগ করতে পারে। আমি এ বিষয়ে শ্রুত বাকী বর্ণনাগুলো লিখতে পারছি না। সরি!


চৌধুরী নিজের মধ্যের পশুটিকে শান্ত করার পর কিছুটা যখন নিস্তেজ আর নির্মোহ হলেন তখন তিনি ভাবলেন, এবার মেয়েটির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা যায়। মেয়েটিকে তিনি কিছু কথা জিজ্ঞেস করলেন; এই যেমন এখানে সে কীভাবে এলো, তার এখানে থাকতে কেমন লাগে, বা এখান থেকে তার চলে যেতে মন চায় কি না এসব। মেয়েটি নাকি ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল কতক্ষণ; একভাবে অপলক। হয়ত সে ভাবছিল বাইরের অন্ধকারের চেয়ে তার জীবনের অন্ধকার অনেক বেশি গভীর কালো। সে জানালো, সে মুসলমান নয়; তার মামা তাকে এখানে এনে বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গেছে। সেই টাকা সুদে আসলে কত হবে, কবে শোধ হবে তা সে জানে না। জানে না সে কোনোদিন সত্যিই মুক্তি পাবে কি না!


জ্বী, আমরা জানি আমাদের এই বর্ণনার জবাব এই ‘গিরিজ সভ্যতা’র ধারক-বাহকদের কাছে আছে। তাদের মানবাধিকার কর্মিরা, যৌন কর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় নিয়োজিত এনজিওরা আমাদেরকে এখন শান্ত করবেন, আশ্বস্ত করার জন্য নসিহত শুনাতে আসবেন যে, যুগ অনেক বদলেছে এখন, চিন্তা করবেন না; এখন তাদের সবার হাতে উন্নতমানের সাস্থ্যসম্মত জেল পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ধিক, তোমাকে হে গিরিজ সভ্যতা!

চৌধুরী একটা ঘুম দিয়ে উঠে আবারও লিপ্ত হলেন। একটা পর্যায়ে মেয়েটা যথারীতি শ্বাসকষ্টের রুগির মতো হাপাচ্ছিল। চৌধুরী প্রথমে লক্ষ করেননি। পরে বুঝতে পেরে বললেন, ‘তুই না পারলে বললি না কেন’। মেয়েটি জানালো, খদ্দের লক্ষ্মী; তাকে কখনও ‘না’ বলা যাবে না। খদ্দের যেভাবে খুশি হবে, যতবারে খুশি হবে ততবার করতে হবে—কিছুতেই ‘না’ বলা যাবে না। তাদেরকে এটা শক্ত করে সর্দারনিরা শিখিয়ে দিয়েছে।


আহ! তোমাদের গিরিজ সভ্যতা! তোমরা স্ত্রীদেরকে শেখাও স্বামীর কোনো অধিকার নেই স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর উপগত হওয়ার—সেটা হবে মেরিটাল রেইপ; স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করতে পারবে। আর বারো বছরের মেয়েটাকে শেখাও ‘খদ্দের লক্ষ্মী— যতবার চাইবে না বলা যাবে না’। বলতে এসো না, তোমাদের আইনে তো এটা নিষিদ্ধ!


যে বছর এই ঘটনাটি আমি চৌধুরীর মুখে শুনেছিলাম তখন আমার মেয়েটিরও বয়স বারো তেরো বছর। কতটুকুন মেয়ে! আমি যখন সেই মেয়েটির জীবনের বিভৎস গল্প শুনছিলাম কেন যেন বারবার কল্পনায় আমার নিজের মেয়েটির ছবি ভেসে উঠছিল। হাতটা নিশপিশ করছিল। চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। এই গিরিজ সভ্যতার ধারকবাহক—পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবি পরা বুদ্ধিজীবী, কিংবা জনতার সমাবেশে ভাষণরত রাজনৈতিক নেতাদের খুজছিল সে হাত। আমার অক্ষমতা যখন আমাকে জানান দিচ্ছিল তা তুমি এখন পারবে না—আমার মুখের গহ্বরে তখন থু থু দলা পাকিয়ে আসছিল।

এই গিরিজ সভ্যতার সুবিধাভোগী, তেল চকচকে কোনো চেহারা খুঁজছিল সেই থুথু! কি নিস্পাপ থাকে এই বয়সের একটি মেয়ে! কত সহজ সরল আর নিষ্কলুষ একটি বয়স। ফুলের মতো কোমল সৌরভে ভরা স্নিগ্ধ একটা জীবন তাদের প্রাপ্য! অথচ এই বয়সে এই সভ্যতা সেই মেয়েটিকে ঠেলে দিয়েছে রাতভর উপর্যুপরি খুবলে খাওয়া পশুর খাঁচায়।


তাই আমি তোমাদের এই সভ্যতাকে আর আধুনিক সভ্যতা বলি না, তোমাদের এই সভ্যতার নাম দিলাম ‘গিরিজ সভ্যতা’।

© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

One thought on “গিরিজ সভ্যতা! — আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক

  1. Arif Ibrahim says:

    very good writing

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *